মতামত

‘আমি যদি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী হতাম’

ahmadul kobir আমার গবেষণা প্রজেক্টের বিষয় “ফরেন ওয়ার্কারস’ চ্যালেঞ্জেস ইন মালয়েশিয়া” এই বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি অনেক সমস্যা চিহ্নিত করেছি। সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে চাকরি না থাকা, ভিসা জটিলতা ও আবাসন সংকট। একজন প্রবাসী শ্রমিক বিদেশে আসতে গড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা খরচ করেন। একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশ যেতে গড়ে ৫,৪৪,০০০ টাকা খরচ হয়। যেখানে নেপাল, ভারত বা ফিলিপাইন থেকে শ্রমিকরা ২ লাখ টাকার কম খরচে মালয়েশিয়ায় আসেন।

শুরুতেই এত খরচ করার পরও প্রায় ২০ শতাংশ শ্রমিক চুক্তিতে উল্লেখিত কাজ বা বেতন বাস্তবে পান না। যারা কাজ পান, তাদের ৮০ শতাংশের নতুন চিন্তা শুরু হয় ১০ মাস পর। কারণ পরবর্তী বছরের ভিসা নবায়ন করতে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা লাগে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে একজন বাংলাদেশি শ্রমিক বলেছেন, “আমরা সপ্তাহে সাত দিনই ১২ ঘণ্টা কাজ করি, কোনো বিশ্রাম ছাড়া”। তবু এই অতিরিক্ত পরিশ্রমের আয় দিয়েও অনেকে ভিসা নবায়নের টাকা জোগাড় করতে পারেন না। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে অবৈধ অবস্থায় চলে যান। এরপর শুরু হয় তাদের আসল জীবনযুদ্ধ। একদিকে ভিসা না থাকার কারণে ভালো কোম্পানিতে কাজ পাওয়া যায় না, অন্যদিকে ইমিগ্রেশন পুলিশের ভয় ২৪ ঘণ্টা তাড়া করে বেড়ায়। অনেকে পুলিশের অভিযানের ভয়ে নির্মাণাধীন ২০ তলা ভবনে উঠে রাত কাটান, কেউ বা রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে লুকিয়ে থাকেন। কিন্তু সবসময় লুকিয়েও পার পাওয়া যায় না। এক প্রবাসী বলেন “তাঁর সঙ্গে থাকা একজন শ্রমিক পুলিশের ধাওয়া খেয়ে ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন”। দিনের পর দিন এভাবেই জীবন কাটাচ্ছেন প্রায় ৪ লাখ অবৈধ প্রবাসী।

বর্তমানে মালয়েশিয়ায় বেকার প্রবাসীর সংখ্যা আনুমানিক ১ লাখ। প্রায় ৪০ শতাংশ শ্রমিক ২–৩ বছর কাজ করার পর বিভিন্ন কারণে চাকরি হারান। ৬ লাখ টাকা ঋণ করে আসা একজন প্রবাসী যখন পুরো টাকা শোধ করার আগেই বেকার হয়ে পড়েন, তখন শুরু হয় তার আর্থিক ও মানসিক সংকট। অনেকে আবার কাজের আশায় দালালের হাতে ১০–২০ হাজার টাকা দিয়ে প্রতারিত হন। কেউ কাজ পেয়ে ২–৩ মাস কাজ করেও বেতন পান না, আবার বৈধ না থাকায় কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন না। অনেকে কম মজুরিতে, দিনে একবেলা খেয়ে, অথবা কখনো না খেয়েই সারাদিন কাটিয়ে দেন।

প্রায় ৩০ শতাংশ শ্রমিক অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করেন। অনেক সময় কাজের স্থানের পাশে পরিত্যক্ত গুদাম বা তাবুতে ৩০–৪০ জন একসঙ্গে থাকেন। দীর্ঘদিন এমন অবস্থায় থাকার ফলে তাদের মধ্যে জটিল রোগের প্রবণতা দেখা দেয়। কিছু শ্রমিক জানান, স্থানীয় সমাজে অভিবাসীদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবও তাদের মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। অথচ তাঁদের অনেকেই জানেন না,  বাংলাদেশে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় নামে একটি দপ্তর আছে অথবা তারা কী ধরনের সেবা দিয়ে থাকে।

আমি যদি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী হতাম, তাহলে প্রতিটি দূতাবাসে একটি আলাদা শাখা স্থাপন করতাম, যেখানে প্রবাসীরা সব ধরনের সহায়তা পেতেন, ঠিক যেন হাসপাতালের মতো, তবে শারীরিক নয়, মানসিক ও প্রশাসনিক ও চাকরিসংক্রান্ত সেবা দেওয়া হতো। প্রতিটি দূতাবাসে আমি তিনজন প্রশিক্ষিত মনস্তাত্ত্বিক নিয়োগ দিতাম, যাদের কাজ হতো প্রবাসীদের সমস্যা শোনা, মানসিক সহায়তা দেওয়া,
সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণে সহায়তা করা।

আরও পাঁচজনের একটি মাঠপর্যায়ের টিম রাখতাম, যাদের তিনজন প্রতিদিন বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজের সুযোগ খুঁজতেন, চুক্তি করতেন, এবং নতুন কর্মীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতেন।
অন্য দুইজন দূতাবাসে থেকে এই চাকরির বণ্টন তদারক করতেন। এর পাশাপাশি দুইজন পরিদর্শক থাকতেন, যারা প্রতিদিন ১০–১৫টি কর্মস্থল পরিদর্শন করে রিপোর্ট নিতেন কোথায় কী সমস্যা হচ্ছে, কারা ভোগান্তিতে আছেন ইত্যাদি। আমি ২৪/৭ হেল্পলাইন চালু করতাম, যেখানে প্রবাসীরা যেকোনো সময় ফোন বা মেসেজে সাহায্য চাইতে পারতেন। প্রয়োজনে কনসালটেন্সি বা আইনগত সহায়তার পরামর্শও দেওয়া হতো।

অবৈধ অবস্থায় পড়া রোধে আমি রাষ্ট্রদূত ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় দুই দেশের আলোচনার মাধ্যমে ভিসা নবায়ন ফি কমানোর উদ্যোগ নিতাম। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে প্রবাসীদের জন্য স্বাস্থ্যকর আবাসন নিশ্চিত করতাম। হয়তো ভাবতে পারেন, প্রতিটি দূতাবাসে অতিরিক্ত ১০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দিলে প্রায় ১০–২০ লাখ টাকা ব্যয় বাড়বে। কিন্তু আমি বলব, এর ফলেই রেমিট্যান্স কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। প্রবাসীরা শুধু অর্থ পাঠান না, তারা দেশের সম্মান, গর্ব ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি। আমি যদি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী হতাম, তাদের কষ্ট নয়, মর্যাদা নিশ্চিত করাই হতো আমার প্রথম দায়িত্ব।

লেখক:  শিক্ষার্থী, আন্তর্যাতিক সম্পর্ক বিভাগ, এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া।
ই-মেইল: omarfaruksaikat@icloud.com

এমন আরো সংবাদ

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker