জলবায়ু পরিবর্তনে অতিবৃষ্টি, কৃষি বিপর্যয় ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
২০২৫ সালের বর্ষা যেন বাংলাদেশকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিল, জলবায়ু পরিবর্তন আর ভবিষ্যতের হুমকি নয়, এটি এখনকার কঠিন বাস্তবতা। গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে যে অতিবৃষ্টি হয়েছে, তা বিগত কয়েক দশকের গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জুলাই মাসে দেশের গড় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের তুলনায় ২৩.৫ শতাংশ বেশি হয়েছে। শুধু তাই নয়, মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিনবার প্রবল নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ে অতিবৃষ্টির ঘটনা ঘটিয়েছে, যার ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। এই বন্যায় অন্তত ৪ লাখ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ কৃষক তাদের আউশ ও আমন মৌসুমের ফসল হারিয়েছেন।
গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান দেখলে প্রবণতাটি আরও স্পষ্ট হয়। ২০২১ সালে মৌসুমি বন্যায় প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যার অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল প্রায় ২,১০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে সিলেট ও সুনামগঞ্জে আকস্মিক বন্যায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয় এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ২০২৩ সালে মৌসুমি বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হওয়ায় বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যায়, যার ফলে বাজারে চালের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। ২০২৪ সালের বন্যা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়—শুধু ধানক্ষেতেই ১১ লাখ টন চাল নষ্ট হয়, যার অর্থমূল্য প্রায় ৮,৫০০ কোটি টাকা। আর ২০২৫ সালে ইতিমধ্যেই কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অন্তত ৩ লাখ হেক্টর জমি ডুবে গেছে, ফুড এ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (ফাও) এর প্রাথমিক হিসাবে আউশ ধানের উৎপাদনে ২০ শতাংশ ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
এই বিপুল ক্ষতির কারণে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, ২০২৫ সালের বন্যার কারণে অন্তত ১৫ লাখ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বাজারে চালের দাম বেড়েছে ১২–১৫ শতাংশ, আর সবজি ও ডালসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারগুলোর ওপর, যাদের আয়ের বড় অংশই খাদ্যে ব্যয় হয়। কৃষি ক্ষতি মানেই শুধু ধান বা গমের ক্ষতি নয়, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মাছ, গবাদি পশু ও সবজির উৎপাদনও। দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় মাছের প্রজনন কমে যাচ্ছে, গবাদি পশুর খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে এবং সবজির জমি দীর্ঘ সময় পানিতে ডুবে থাকায় কৃষকের আর্থিক ক্ষতি বহুগুণে বাড়ছে।
বাস্তুতন্ত্রেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। টানা অতিবৃষ্টির কারণে মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, কারণ অতিরিক্ত জলাবদ্ধতা জমির জৈব পদার্থ ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নদীতীরবর্তী জমি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কৃষিযোগ্য জমি হারাচ্ছে কৃষকরা। জলাভূমির বাস্তুতন্ত্রে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। বন্যায় মিঠাজলের সঙ্গে লোনা পানির মিশ্রণে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি জমি অযোগ্য হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন জানিয়েছে, টানা বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে বাংলাদেশের অন্তত ৩০ শতাংশ জলাভূমি বাস্তুতন্ত্রে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে।
এখন প্রশ্ন আসে, এই অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন কতটা দায়ী। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, গড় তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বাতাসে আর্দ্রতা ধারণের ক্ষমতা ৬–৭ শতাংশ বেড়ে যায়। বঙ্গোপসাগরের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা গত ৫০ বছরে প্রায় ১ ডিগ্রি বেড়েছে। এর ফলে সাগর থেকে বাষ্পীভবন বেড়েছে, আর নিম্নচাপ বা মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হলে অতিরিক্ত জলীয়বাষ্প প্রবল বর্ষণে রূপ নিচ্ছে। এ কারণেই আইপিসিসির ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রবল বর্ষণ ও বন্যার ঝুঁকি ২০৫০ সালের মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ বাড়বে। সুতরাং ২০২৫ সালের বাংলাদেশে অতিবৃষ্টি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফলাফল, এটি শুধু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া নয়।
অতিবৃষ্টির ক্ষতি শুধু কৃষি বা খাদ্য খাতে সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে অন্তত ৩ সপ্তাহ ধরে, স্বাস্থ্য খাতে পানিবাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়া ও হেপাটাইটিস বেড়েছে ৪০ শতাংশ। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে পানির উচ্চতা বেড়ে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় রাস্তা ও রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের অতিবৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এই পরিস্থিতিতে অভিযোজনই একমাত্র পথ। প্রথমত, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে নগদ সহায়তা, ভর্তুকিযুক্ত বীজ ও সার সরবরাহ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বন্যাসহিষ্ণু ধান জাত যেমন “স্কুবা রাইস” সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতিমধ্যে এ ধরনের জাত উদ্ভাবন করেছে, কিন্তু সেগুলো মাঠপর্যায়ে পৌঁছাতে সময় নিচ্ছে। তৃতীয়ত, স্থানীয় পর্যায়ে খাল খনন, ছোট বাঁধ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন ও নদী খননের মাধ্যমে জমির জলাবদ্ধতা কমাতে হবে। চতুর্থত, কৃষি বীমা চালু করতে হবে যাতে কৃষকরা ক্ষতির পর আর্থিক সহায়তা পায়। পঞ্চমত, আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে “লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড” ব্যবহার করে বৃহৎ অভিযোজন প্রকল্প হাতে নিতে হবে। জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই এ তহবিলে বাংলাদেশের জন্য সহায়তার কথা বলেছে, সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
এ কথা বলা যায় যে,২০২৫ সালের অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত আমাদের জন্য একটি কঠিন বার্তা। গত পাঁচ বছরের ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কেবল ভবিষ্যতের হুমকি নয়, এটি এখনকার কঠিন বাস্তবতা। কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো—সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হলো, অভিযোজন কৌশলকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা এবং আন্তর্জাতিক সহায়তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। নাহলে এই অতিবৃষ্টি ও বন্যার চক্র আগামী বছরগুলোতে আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।
- আসাদুজ্জামান সম্রাট, সিনিয়র সাংবাদিক ও জলবায়ুকর্মী



