জলবায়ু পরিবর্তনমতামত

আসন্ন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন: আমাদের বর্তমান অবস্থা ও করণীয়

cop 30১. “সম্মেলন” বললেই আমাদের মনে প্রথমে ভেসে ওঠে ঝলমলে মঞ্চ, রাষ্ট্রনেতাদের বা বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের জাঁকজমকপূর্ণ উপস্থিতি, দীর্ঘ বক্তৃতা আর মোটা ঘোষণাপত্র। কিন্তু প্রশ্ন হলোঃ এসব ঘোষণাতে আমাদের জীবনে কি আসলেই কোন পরিবর্তন আসে? সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল ডুবে যাচ্ছে, উপকূলের ভাঙা ঘরে মানুষ আজও ঘূর্ণিঝড়ের পর আশ্রয় খুঁজছে। লবণাক্ত পানিতে, অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির কারণে ব্যহত হয় কৃষিকাজ সহ নানান পেশার কার্যক্রম। এত সমস্যার সম্মুখীন হওয়া জনগণের কাছে তখন এসব সম্মেলন হয়ে যায় প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার এক বিস্তর পার্থক্য।

বিশ্বব্যাপী এই জলবায়ু পরিবর্তন ও তার ব্যাপক প্রভাব মোকাবিলার জন্য ১৯৯৫ সালে শুরু হয়েছিল একটি বৈশ্বিক সম্মেলনের যাত্রা; ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কাঠামো চুক্তি বা UNFCCC বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সম্মেলনের পটভূমি রচিত হয়। এই চুক্তিতে সাক্ষরকারী সকল দেশ (Parties) প্রতি বছর জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেয়, যা Conference of the Parties (COP) নামে সমধিক পরিচিত। তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই আমরা শুনছি উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি; কার্বন নিঃসরণ কমানো,  ভুক্তভোগী দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন বাড়ানো, ও সহজ পন্থায় এই সহযোগিতা পাওয়ার আশ্বাস। ২০০৯ সালে উন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার, যেই কথার মেয়াদ শেষ হবে এই ২০২৫ সালেই। আজারবাইজানে আয়োজিত সর্বশেষ (২০২৪) সম্মেলনের তথ্য অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তিনগুণ (৩০০ বিলিয়ন ডলার) দেয়ার অঙ্গীকার করেছে ‌উন্নত বিশ্ব। সেই টাকার আবার সামান্য অংশই আসে, হয়তো আর্থিক সহায়তা অথবা ঋণ হিসেবে।

তাদের বক্তব্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শব্দও দেখা যায়ঃ “ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর (Just Transition)”, “কার্বন বানিজ্য (Carbon Market)” কিংবা “ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ তহবিল (Loss and Damage Fund)” । কিন্তু বাস্তবে সেগুলো কাগজেই আটকে থাকে। উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। তাহলে তাদের কাছ থেকে কতটা আন্তরিকতা আশা করা যায়?

২. এই সম্মেলনেই বারবার উঠে আসে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির কথা। শুনতে অল্প তাপমাত্রা মনে হলেও, বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা শিল্পবিপ্লব (১৮৫০-১৯০০ সাল) সময়ের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি বেশি বেড়ে গেলে দুর্যোগ, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও খাদ্য সংকট মারাত্মক হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল, যা বর্তমান সময়ে প্রায় প্রমাণিত। ২০১৫ সালে গৃহীত প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, সদস্য দেশসমূহ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে (১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না হওয়া), গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করতে জাতীয় অঙ্গীকার (NDCs) তৈরীতে, জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করবে। কিন্তু, বেশিরভাগ উন্নত দেশের অনবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা, রাষ্ট্রীয় অস্থিতিশীলতা ও সদিচ্ছার অভাবে, বিশ্বের অনেক দেশই এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে বারংবার। প্রসংগত। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির চেয়েও কিছুটা বেড়েছে, যদিও  এর জন্য এল নিনো (পৃথিবীর আবহাওয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও চরম পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী প্রাকৃতিক ঘটনা) এর মত প্রকৃতিগত পরিবর্তন অনেকাংশে দায়ী।

এক্ষেত্রে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো বারবার বলছে- “আমরা জলবায়ুর নির্মমতার জন্য দায়ী নই, আমরা ভুক্তভোগী”। তাই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য অর্থায়ন কোনো দয়া নয়, এটি বৈশ্বিক ন্যায্যতা। ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ তহবিল (Loss and Damage Fund), অভিযোজন (Adaptation) তহবিল, কেবল ঘোষণার মধ্যে থাকলে চলবে না; দ্রুত ও কার্যকর বাস্তবায়ন জরুরি। বর্তমানে প্রশমন (mitigation) খাতে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা উন্নত দেশগুলোর প্রযুক্তি ও ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু যেসকল উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনই জলবায়ুর প্রভাবের সাথে লড়ছে, এই প্রভাবগুলোর সাথে জীবন কাটানোই হলো তাদের মূল চ্যালেঞ্জ। সেক্ষেত্রে, তাদের প্রথম চাহিদাই হবে অভিযোজন: যেন বিভিন্ন দুর্যোগের তীব্রতা ও পুনরাবৃত্তিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কমে আসে।

৩. বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলছে জলবায়ু সংকট কোনো ভবিষ্যতের হুমকি নয়; এটি বর্তমানের বাস্তবতা। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর প্রায় ৪,০০০ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ২৬ লাখেরও বেশি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। প্রতি বছর নদীভাঙনে গড়ে দশ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়। দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা লবণাক্ত পানিতে ডুবে যাচ্ছে, উত্তরাঞ্চলে খরায় ফসল নষ্ট হচ্ছে। সমস্যার সমাধান হিসেবে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি ও স্থানীয়দের মাঝে সচেতনতা আরো বৃদ্ধি করা, লবণাক্ততা সহনশীল ফসল উদ্ভাবন, আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা আরো জোরদার করা ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব নয়। তবে, এসকল কাজের জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সম্পদ এবং প্রচুর অর্থায়ন।

বাংলাদেশ প্রতি বছর চরম আবহাওয়ার কারণে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এক্ষেত্রে,  ২০৫০ সালের মধ্যে তার জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (NAP) অনুযায়ী জলবায়ু সহনশীলতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন মোট ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; যার মধ্যে প্রতি বছর অভিযোজনমূলক পদক্ষেপ নিতে আনুমানিক খরচ হতে পারে ৮.৫ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া, মোট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি বছর ৩০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন রয়েছে, যেখানে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (IMF) থেকে অর্থ সংগ্রহ করা এখনো একটি বড় বাঁধা হিসেবে রয়ে গেছে। দেশের একটি নিজস্ব তহবিল আছে, যার পূর্ণরূপ হলো বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড (BCCTF)। ২০০৯ সালে গঠিত এই তহবিলের মূল উদ্দেশ্য হলো দুর্যোগ প্রতিরোধ ও অভিযোজন, নবায়নযোগ্য শক্তি ও সবুজ প্রকল্পে সহায়তা, এবং ক্ষতি ও ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে স্থানীয়দের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ফান্ডের অর্থায়ন আসে সরকারি বাজেট এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা থেকে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। ২০২৬ সালে জাতিরসংঘের স্বল্পন্নোত দেশের তালিকা থেকে দেশটির উত্তীর্ণ হওয়ার কথা রয়েছে। তবুও, এই ট্রাস্ট ফান্ডের জন্য যে জাতীয় বাজেট ধরা হয় অথবা আন্তর্জাতিক তহবিলগুলো থেকে যা আসে তা প্রয়োজনের অতি সামান্য অংশ। ফলে জলবায়ু ও পরিবেশ নিয়ে কর্মরত সকলের পাশাপাশি জনসাধারণের করণীয় তিনটি দিক একদম স্পষ্ট: প্রথমত, বৈশ্বিক দরকষাকষিতে আরও কঠোর হওয়া; অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের দাবিকে দৃঢ়ভাবে ও তথ্যসমৃদ্ধ ভাবে উপস্থাপন করা। দ্বিতীয়ত, নিজস্ব জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডকে স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করা, যাতে অর্থায়ন কার্যকরভাবে কাজে লাগতে পারে এবং স্থানীয় পর্যায়ে প্রকল্পগুলো সুফল বণ্টন করতে সক্ষম হয়। তৃতীয়ত, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও স্থানীয় অভিযোজন প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো, যাতে সবুজ শক্তি ব্যবহার ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী ভিত্তিক অভিযোজন কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা যায়।

৪. প্রতিশ্রুতির ভেলায় লম্বা সময় ভাসলে হয়তো সময়ের সাথে লোনা পানিতে তলিয়ে যাবে একের পর এক অঞ্চল। তাই চলতি বছরের এই জলবায়ু সম্মেলন আমাদের জন্য কেবল কূটনৈতিক আয়োজন নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব ও আমাদের লড়াই করে টিকে থাকার প্রশ্ন। উন্নত বিশ্ব যদি সত্যিই ন্যায়সঙ্গত হতে চায়, তবে এখনই সময় তাদের প্রতিশ্রুত অর্থায়ন যথাযথভাবে কার্যকর করা।

আর বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাজ হলো ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর তোলা। কারণ একক দেশ হিসেবে আমরা ছোট, কিন্তু একসঙ্গে হলে আমাদের দাবি হবে দৃঢ়, আরো বলিষ্ঠ।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker