মালয়েশিয়ার জাতীয় গ্রন্থাগারে ডিজিটাল নবজাগরণ
একসময় নিস্তব্ধ ও বইয়ের তাকঘেরা স্থান হিসেবে পরিচিত মালয়েশিয়ার জাতীয় গ্রন্থাগার (PNM) এখন বদলে যাচ্ছে ডিজিটাল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে। আধুনিক প্রযুক্তি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও ইন্টারঅ্যাকটিভ শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি নতুন প্রাণ পাচ্ছে। জাতীয় ঐক্য মন্ত্রী অ্যারন আগো দাগাং-এর নেতৃত্বে গ্রন্থাগারের মূল ভবনে স্থাপিত “ইমার্সিভ লার্নিং সেন্টার” এখন দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করছে হোলো-ওয়াল, ইন্টারঅ্যাকটিভ তথ্যপ্যানেল এবং বাঁকানো এলইডি পর্দার মাধ্যমে।
PNM-এর ডিজিটাল প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়ান আজুয়ান শাহ ওয়ান মোহাম্মদ বলেন, আমরা শুধু বই ও দলিল সংরক্ষণ নয়, বরং অনুসন্ধান, উদ্ভাবন ও নতুন জ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে চাই, যা আন্তর্জাতিক ডিজিটাল শিক্ষার প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, “তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে আমাদের বড় পরিবর্তন আনতে হবে।”
ইমার্সিভ লার্নিং সেন্টারের পাশাপাশি মালয়েশিয়ার জাতীয় গ্রন্থাগারে এখন রয়েছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি স্পেস, ই-স্পোর্টস জোন ও রোবোটিক্স জোন। এ ছাড়াও রয়েছে হোলোগ্রাফিক স্পেস, মেটাভার্স রুম এবং “ট্রি অফ নলেজ” — সবকিছুই আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর। ওয়ান আজুয়ান জানান, “এই সব ইন্টারঅ্যাকটিভ গেম PNM-এর নিজস্ব উপকরণকে ভিত্তি করে তৈরি, যাতে জ্ঞান উপস্থাপিত হচ্ছে অ্যানিমেশন ও গেমের মাধ্যমে। একইসঙ্গে, এসব গেম ঐক্য ও সংস্কৃতিকে একত্রে তুলে ধরছে—যেমন খাবার বা পোশাককে সংস্কৃতির সঙ্গে মেলানো।”
ডিজিটাল রূপান্তরের পাশাপাশি, PNM তার u-Pustaka সিস্টেম-কেও উন্নত করেছে। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা দেশের ১২টি গ্রন্থাগারের কনসোর্টিয়ামে প্রবেশাধিকার পান, ১৯১টি গ্রন্থাগারের ক্যাটালগ অনুসন্ধান করতে পারেন এবং ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল পাঠ্য উপকরণ পড়তে পারেন।
গ্রন্থাগার সিস্টেম ও নেটওয়ার্কের সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর কাসুমা দেউই সাঈদ বলেন, “ব্যবহারকারীরা u-Pustaka-এর সহজ ও কার্যকর ব্যবস্থার প্রশংসা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি কুয়ালালামপুরে থাকেন এবং সাবাহ থেকে কোনো বই ধার নিতে চান, তবে সেই বই পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে সরাসরি তার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”
তিনি আরও জানান, বর্তমানে u-Pustaka-তে ১৭টি ডেটা সেন্টার থেকে ২,৯৩,০০৬টি ডিজিটাল উপকরণ রয়েছে—যার মধ্যে বই, ম্যাগাজিন, জার্নাল, সংবাদপত্র, অডিওবুক ও ই-লার্নিং সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত। এ পর্যন্ত সদস্য সংখ্যা ১০ লাখ ৮৬ হাজারেরও বেশি, যার মধ্যে বছরে গড়ে ১ লাখ সদস্য সক্রিয় থাকে। PNM তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জাতীয় মালয় পাণ্ডুলিপি কেন্দ্র (PKMM)-এ হাজারো পুরনো জাওয়ি পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ও ডিজিটাল আকারে রাখা হয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে PNM এখন পর্যন্ত ৫,৩০০টিরও বেশি মূল পাণ্ডুলিপি ও প্রায় ৫,০০০টি ডিজিটাল পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছে—যা মালয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংরক্ষণাগার। PKMM-এর সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর ফাতিমাহ আবদুল হাই জানান, সাম্প্রতিক সংযোজনগুলোর মধ্যে একটি পাণ্ডুলিপি রয়েছে, যা মালয় উপদ্বীপের স্বাধীনতা সংগ্রামী মাত কিলাউ-এর জীবনী বলে ধারণা করা হয়।
তিনি বলেন, “বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে পাণ্ডুলিপিটি এখন PNM-এর সংগ্রহে এসেছে এবং গবেষকদের জন্য এটি এখন উন্মুক্ত।” বর্তমানে PNM-এর ১০টি মালয় পাণ্ডুলিপি আন্তর্জাতিক “Memory of the World” স্বীকৃতি পেয়েছে, এবং আরও ১২টি জাতীয় ঐতিহ্য আইন ২০০৫-এর অধীনে জাতীয় ঐতিহ্য বস্তু হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রন্থাগার ব্যবস্থায় ডিজিটাল পরিবর্তনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, তবে তা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। জাতীয় গ্রন্থাগার, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি গ্রন্থাগারগুলোতে অনলাইন ক্যাটালগ, ই-রিসোর্স ও ডিজিটাল আর্কাইভ চালুর কাজ শুরু হয়েছে। তবে গ্রামীণ ও উপজেলা পর্যায়ের লাইব্রেরিগুলো এখনো প্রচলিত পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মালয়েশিয়ার জাতীয় গ্রন্থাগারের মতো ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, ই-স্পোর্টস বা ইন্টারঅ্যাকটিভ লার্নিং সেন্টার গড়ে তোলার উদ্যোগ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে বই ও জ্ঞানের প্রতি নতুনভাবে আকৃষ্ট করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন আধুনিক অবকাঠামো, প্রযুক্তি সহায়তা, প্রশিক্ষিত জনবল এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। মালয়েশিয়ার জাতীয় গ্রন্থাগার আজ শুধুই জ্ঞানের ভান্ডার নয়—এটি হয়ে উঠছে ডিজিটাল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র। আর বাংলাদেশও যদি একইভাবে প্রযুক্তিনির্ভর গ্রন্থাগার সংস্কৃতিকে অগ্রাধিকার দেয়, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে এটি হতে পারে এক নতুন দিগন্ত।



