লন্ডনের পার্কে থেমে গেল সাবিনার স্বপ্ন
সাবিনা নেসা (১৯৯৩-২০২১) ছিলেন লন্ডনে জন্মগ্রহণকারী একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিক্ষিকা
লন্ডনের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় শান্ত এক আবাসিক এলাকার নাম কিডব্রুক। সদ্য গড়ে উঠা নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্ট, শিশুদের জন্য খেলার মাঠ, অবারিত সবুজ পথ-ঘাট আর কফিশপের সমাহার—সব মিলিয়ে সাজানো-গোছানো আধুনিক এক নতুন উপশহর। ব্যস্ততম নগর জীবনের কোলাহল আর যান্ত্রিকতা থেকে কিছুটার স্বস্তি পেতে অনেকেই এখানে আবাসন গড়েন। আবাসন গড়েন বাঙালি বংশোদ্ভূত এক তরুণী সাবিনা নেসাও। শিক্ষানুরাগী সাবিনা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন । যোগ দেন একটি স্কুলে। অল্প দিনের মধ্যেই অর্জন করেন পেশাগত দক্ষতা আর হয়ে উঠেছিলেন শিশুদের মধ্যমনি।
২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। এক সাধারণ শনিবার সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে বের হয়েছিলেন সাবিনা। হাতে তার মোবাইল, পরনে প্রিন্টেড ম্যাক্সি—সাধারণ দিনের মতোই হাঁটছিলেন। বিস্তৃত ক্যাটর পার্কের মাঝখান দিয়ে পাঁচ মিনিটের হাটার রাস্তা মাত্র। কিন্তু নাহ! এ পাঁচ মিনিটের রাস্তা সাবিনা অতিক্রম করতে পারে নি। ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার আধো আলো আধো অন্ধকারে মানুষরূপী এক হায়েনার ভয়াল থাবায় তার পথচলা থেমে যায়। রেস্টুরেন্টে অপেক্ষমান বন্ধুদের কাছে আর পৌঁছাতে পারেনি সে। রেস্টুরেন্টে তার বন্ধুরা অপেক্ষা করতে থাকে। অপেক্ষার পর অপেক্ষা, ফোনের পর ফোন। কিন্তু সাবিনা না ধরছে ফোন আর না দেখা যাচ্ছে তার হাস্যজ্জ্বল চেহারা। অস্তির হয়ে উঠে বন্ধুরা। চারিদিকে সব জায়গায় খোঁজ করে। কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া যায় না।
অবশেষে দুদিন পর পার্কের এক কোণে শতবর্ষী এক গাছের নিচে তাকে পাওয়া যায়। তবে জীবিত নয়, প্রাণহীন। তার মাথায় বারংবার আঘাতের চিহ্ন, পাশেই পড়ে থাকা লোহার পাইপ—মধ্যযুগীয় বর্বরতার এক নির্মম প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান হয় শতবর্ষী গাছটির নীচে।
সাবিনার জন্ম ১৯৯৩ সালে লন্ডনের পূর্ব প্রান্তে। পরিবারের আদি নিবাস বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে। বাবা আব্দুল নূর কর্মজীবন শেষ করেছেন রেস্টুরেন্টে কাজ করে, মা আজমিন নেসা গৃহিণী। পাঁচ বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সাবিনা।
গ্রিনউইচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষায় ডিগ্রি নিয়ে তিনি রুসেল প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। হয়ে উঠেন শিক্ষার্থীদের অতিপ্রিয় “মিস সাবিনা”। শুধু শিক্ষক নয়, সে ছিল শিশুদের বন্ধু, অভিভাবক আর প্রেরণার উৎস। তার চোখে স্বপ্ন ছিল, একদিন সে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্যের মধ্যে শিশু শিক্ষা বিনিময় কর্মসূচি চালু করবেন। তার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল।
মানুষরূপী হায়েনার নাম কোচি সেলামাজ। ছত্রিশ বছর বয়সী এ হায়েনা আলবেনীয় বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ নাগরিক। একসময় পিজ্জা ডেলিভারির কাজ করলেও পরে বেকার হয়ে পড়ে। সহিংস স্বভাব ও মানসিক অস্থিরতার ইতিহাস ছিল তার।
ফরেনসিক রিপোর্টে জানা যায়, সাবিনার উপর আক্রমণের আগে সে দীর্ঘক্ষণ পার্কে ঘোরাফেরা করেছিল। হাতে ছিল লোহার পাইপ। রাত ৮টা ৩০ মিনিটে সুযোগ পেয়ে সে সাবিনার মাথায় ১৫ বার আঘাত করে এবং গলা টিপে হত্যা নিশ্চিত করে। এরপর মরদেহ পাতা ও ঘাসে ঢেকে রেখে যায় পার্কে।
পরদিন সকালে এক পথচারী কুকুর হাঁটাতে গিয়ে সাবিনার মরদেহ খুঁজে পায়। আশ্চর্যের বিষয়, সাবিনার ফোন বা পার্স কিছুই খোয়া যায়নি।
সাবিনার মৃত্যুতে লন্ডন জুড়ে শোক ও ক্ষোভের ঝড় ওঠে। রাস্তায় নামে অসংখ্য নারী, মোমবাতি জ্বালিয়ে জানায় প্রতিবাদ—“আমরা আর নীরব থাকব না।”
২৯ সেপ্টেম্বর পুলিশ সেলামাজকে গ্রেফতার করে। ডিএনএ পরীক্ষা ও মোবাইল লোকেশন তাকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে। আদালত তাকে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ অপরাধী ঘোষণা করে এবং কমপক্ষে ৩৬ বছর কারাভোগসহ আজীবন কারাদণ্ড দেয়।
“তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল—এ এক দানব! কেন সে এমনভাবে আমার বোনকে হত্যা করল?” -এটাই ছিল এজলাসে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষরূপী পশু সোলমাজের প্রতি সাবিনার বড় বোন জেবিনার অভিব্যক্তি
এ নিয়ে শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যেই তোলপাড় হয়না। তোলপাড় হয় বিশ্বজুরে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস ও আল জাজিরা এ হত্যাকাণ্ডকে গুরুত্বসহকারে প্রচার করে। ব্রিটেনে নারী নিরাপত্তা নিয়ে বড় বিতর্ক শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় সরকার ২০২৩ সালে “উইমেন’স সেফটি অ্যাক্ট” পাশ করে, যাতে হয়রানি রোধ, সিসিটিভি বাড়ানো ও নিরাপদ এলাকা চিহ্নিতকরণের বিধান রাখা হয়। তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলেন—“শুধু নারীদের সতর্ক থাকতে বললে হবে না, পুরুষদের আচরণ না বদলালে এ আইন কার্যকর হবে না।”
তথ্য মতে, ২০২১-২২ সালে ব্রিটেনে নারী হত্যার হার বেড়েছে ১৬%। এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতা আরও প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে।
সাবিনা নেসা শুধুমাত্র এক তরুণীর নামই নয়, বরং তার নাম আজ নারী নিরাপত্তা আন্দোলনের সমার্থক। তার স্মৃতিকে অমলিন করে লন্ডনের এক স্কুলে গড়ে উঠেছে “সাবিনা নেসা মেমোরিয়াল গার্ডেন।” আমাদের সবার প্রিয় সাবিনার স্মৃতি হোক অমলিন।



