ভ্রমণ

রংরাং থেকে নেমে এলাম খ্যামচং পাড়ায়

ভবঘুরের খেরোখাতা

আলীকদমের ছোট্ট ছবির মত সুন্দর একটি পাড়া, খ্যামচং পাড়া, অনেকে বলে পারাও পাড়া। পাহাড়ের ঢালে এগারোটি পরিবার, সকলেই মুরং। পাহাড়ের উপর থেকে তাকালে আপনাকে মুগ্ধ হয়ে দাড়িয়ে যেতেই হবে। নিজের অজান্তেই আংগুল চলে যাবে ক্যামেরার সাটারে। অনেকক্ষন ট্রেকিং করার পর ছবির মতো এমন একটা পাহাড়ি একটা গ্রাম দেখলে যেকারোই মন আনন্দে নেচে উঠতে বাধ্য, প্রথমত এমন সুন্দর একটা দৃশ্যর ভালোলাগা আর দ্বিতীয়ত কঠিন ট্রেকিংএর আপাত পরিসমাপ্তিতে। ক্রিস্তং রংরাং (অনেকে বলে রুংরাং) এর পথে ট্রেকিং এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পানির উৎসের স্বল্পতা, পথে কোন দোকান না থাকা ও এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ার দুরত্ব। ফলশ্রুতিতে পানি ও খাবার বহন করার কারনে ব্যাগের ওজন বেশী থাকে। আর কিছুক্ষন পরপর প্রশ্ন আর কতদুর? আর কয়টি পাহাড় পার হতে হবে? আর কতক্ষন লাগবে? এই অবস্থায় একটা পাড়ায় পৌছাতে পারা মানে বিশ্রামের সুযোগ, গোসলের সযোগ, ইচ্ছামতো পানি পানের সুযোগ এবং রান্না করে খাওয়ার সুযোগ। সবচেয়ে বড় স্বস্থি হচ্ছে লক্ষের দিকে আর এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার।

2358খ্যামচং পাড়ার শুরুতেই একটি নোটিশ বোর্ডে নির্দেশনা চোখে পরলো, বাংলায় এবং তাদের স্থানীয় ভাষায় লেখা, “সবাই অনুরোধ করছি, দয়া করে এই পাড়ায় প্রবেশ করলে মদ, গাজা, ইয়াবা, আফিন ইত্যাদি নিয়ে আসা যাবে না। যদি এসব দ্রব্য প্রবেশ করলে ৫,০০০ টাকা জরিমানা দিতে বাধ্য হতে হবে।” নির্দেশনা পেড়িয়ে কাঠের একটা অনাড়ম্বন প্রধান ফটক পেড়িয়ে পাড়ার মধ্যে ঢুকে পড়লাম ধীরে ধীরে। ল্যাং মুরং এর পিছু পিছু আমরা আসলাম ডং মুরং এর ঘরের সামনে। পাড়ার একদম শেষ মাথায় ডং মুরং এর ঘর। বেশ বড় একটা ঘড়, ঢোকার মুখেই ছোট একটা বারান্দা। ঘরের বাম পাশে আর একটা বড় খোলা বারান্দা। বারান্দার রেলিংএ বসে থাকা একটা বন মোরগ স্বভাবসুলভ ডাকে আমাদেরকে স্বাগত জানালো। সিড়ি দিয়ে মাচায় উঠে বারান্দা পেড়িয়ে আমরা ঘরে ঢুকে পরলাম। বড় একটা ঘড়, অন্যান্য মুরং ঘরের মতো এক পাশে রান্নার ব্যবস্থা। একপাশে দেওয়ালে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঝুলিয়ে রাখা। এই ঘরের ভিতর দিয়ে পাশের ছোট ঘরটাতে যাওয়ার দরজা। দরজার পাশেই কলাপাতায় মোড়ানো তিনটি প্যাকেট। ছাদে ঝুলিয়ে রাখা বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন ধরনের ঝুড়ি। ঘরের আর একপাশে বিছানা বালিশ গুছিয়ে রাখা, দেওয়ালে কাপড়চোপড় ঝুলিয়ে রাখা। এইপাশে আমরা আমাদের ব্যাগ রেখেই শরীর এলিয়ে দিলাম মেঝেতে।

58এরপর আমরা বের হলাম ফ্রেস হবার জন্য, গোসল করতে হবে। মনে হচ্ছে কত যুগ গোসল করি না। আবারও নীচে নামতে হবে ছরায়। কি আর করার পাহার বেয়ে নীচে নামা শুরু করলাম। সেখানে যে আমাদের জন্য আর এক বিশ্বয় অপেক্ষা করছিল তা কে জানত? পাহাডড়ের পাথর এর মধ্যে একটা গর্ত উপরে একটা ছাউনি দেওয়া যাতে ময়লা পাতা নোংরা পানির মধ্যে না পরতে পারে। এই গর্তের মধ্যে কোথায় থেকে পানি আসতেছে এটি আসলে এক বিরাট বিস্ময়। এর আগে আমরা ম্যনিয়াং পাড়ায় দেখেছি, কিন্তু এটা সম্পুর্ন আলাদা। সৃষ্টিকর্তা যেন এই পাহাড়ী জনপদের মানুষদের বেঁচে থাকার জন্য এই ধরনের বিস্ময়কর সব পানির উৎসব দিয়ে রেখেছেন এই পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায়।

পাড়ার লোকজন সেখানে কেউ পানি সংগ্রহ করছে, কেউবা গোসল করছে, আমাদের দেখে তারা আমাদেরকে আগে গোসল করার জন্য জায়গা ছেড়ে দিল। শীতল পানিতে গোসল করে আমরা আমাদের সব ক্লান্তি দুর করলাম। সকলে ফ্রেশ হয়ে বোতলে খাবার পানি সংগ্রহ করে আমরা আবার উপরে উঠে আসলাম ডং দার ঘরে। তখন একটার মতো বাজে, ডং দার সাথে কথা হলো ২:৩০ থেকে তিনটার মধ্যে আমরা রওনা দিব ক্রিস তং এর উদ্দেশ্য, এবার আমাদের সঙ্গে গাইড হিসেবে থাকবেন ডং দা নিজেই। তাহলে এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে আমাদের খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিতে হবে, আবারো রান্নার দায়িত্ব নিলেন আমাদের রন্ধন রাজ হাসান ভাই তাকে সর্বাত্মক সাহায্য করছেন উসাই মারমা। অল্প সময়ে রান্না করতে হবে তাই সিদ্ধান্ত হল খিচুড়ি রান্না হবে। আমাদের রেডি খিচুড়ি মিক্স আছে, রান্না শুরু হয়ে গেল আর আমি ক্যামেরা নিয়ে চলে গেলাম খোলা বারান্দায়।

বিরাট বড় একটা খোলা বারান্দা, প্রায় থাকার ঘরটার সমান। মুরংদের সব ঘরের সংগেই আপনি এমন খোলা বারান্দা দেখতে পাবেন। ডং মুরং এর বারান্দা থেকে পুরো পাড়াটাই দেখা যায়। কোথাও কোন নোংরা বা আবর্জনা চোখে পড়লো না। পুরো গ্রামটাই পাহারের ঢালে হওয়ায় প্রত্যেকটা ঘরের মাচার একটা পাশ মাটির কাছাকাছি হলেও অপর পাশটা বেশ উচু। খোলা বারান্দা থেকে পাড়া দেখা শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম খ্যামচং পাড়া দেখতে। হাটছিলাম ও মুগ্ধ নয়নে দেখছিলাম। আগেই বলেছি, মনে হয় শিল্পীর তুলিতে আঁকা একটি গ্রাম, যেখানে শিল্পী পাহাড়ের খাচে থাচে বসিয়ে দিয়েছেনে এক একটি করে ঘর। মুগ্ধতার ঘোর কাটলো একদল শিশুর হাসির শব্দে।

পাশের মাঠেই একদল ছোট ছোট বাচ্চা খেলছে, আমাকে দেখতেই দৌড় দিয়ে আড়ালে চলে গেল। ভাব জমানোর চেষ্টা করলাম কাজ হলো না, আড়াল থেকে মাথা বের করে থিল খিল হাসি। একদিকে দেখলাম তিন-চারটা ছেলে একটা ঠেলা গাড়ি নিয়ে খেলছে, অদ্ভুত সুন্দর একটা গাড়ি। ছবি তোলার চেষ্টা করতেই দ্রুত তারা টানা গাড়ি নিয়ে পালিয়ে গেল। পাশেই গাছের নিচে একটা বসার যায়গা, সেখানে বসে মাউথ অর্গান বের করে বাজানো শুরু করলাম, এক এক করে বের হতে শুরু করলো শিশুগুলো। ওরা মন্দিরা ও অন্যান্য যন্ত্র আমার কাছ থেকে নিয়ে যোগ দিল। কিন্তু যখনি মোবাইল বের করে ছবি তুলতে গেছি সব ফেলে দে দৌড়।

আমি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম, পাহাড়ের খাচে খটে ঘর তুলেছে ১১টি পরিবার। বেশিরভাগ ঘড় বাশ, কাঠ ও ছনের তৈরী। অল্পকিছু ঘড়ে টিনের চাল। এরা বাশের কাজ খুব ভালো করে। কত নিপুণভাবে তারা তাদের নিজের ঘর গুলো তৈরি করেছে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। এক একটা ঘর এক একটা বাড়ি, বিশাল বারান্দা আছে, রান্নার ব্যবস্থা আছে শোবার ঘরেরই এক কোনায়। দরকারি সব জিনিস এর মাঝেই সাজিয়ে রেখেছে নিপুন দক্ষতায়। প্রতিটি পরিবার গশু পালন কওে, বেশির ভাগই শুকর ও গরু। কিছু কিছু পরিবার গয়াল, মুরগি এমনকি কবুতরও পালন করে। প্রতিটি পরিবার তাদের খাদ্যের জন্য নির্ভর করে জুম চাষের উপর। পুরো পাড়া ঘুরে দেখতে দেখতে প্রায় এক ঘন্টার মতো লাগল। ডং দার ঘরে এসে দেখি রান্না শেষ, এখন খাওয়ার পালা। খাওয়া শেষে ডং মুরং এর বারান্দা থেকে তাকিয়ে দেখছিলাম এক পাশে ছোট্ট সুন্দর একটি গ্রাম আর এক পাশে বীরদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রং রাং। কি যে অপরূপ সৌন্দর্য তা চোখে না দেখলে বর্ণনা করা সম্ভব না। কিরণ ভাইএর ডাকে ঘরে আসলাম, আমাদের বের হতে হবে, আমাদের লক্ষ্য ক্রিস তং (চলবে)

এমন আরো সংবাদ

Back to top button