২০০৯ সাল। ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ার শহর লিমিংটনের এক ফ্ল্যাটে পিতার মৃত্যুর পর ঘর পরিষ্কার করছিলেন অ্যান্টনি ইস্টন। হঠাৎ বিছানার নিচে পাওয়া গেল একটি পুরনো বাদামি চামড়ার স্যুটকেস। ভেতরে ছিল অগোছালো কিছু পুরনো নোট, জার্মান মুদ্রা, ছবি আর একখানা জন্মসনদ। তাতে লেখা—পিটার হান্স রুডলফ আইসনার। অ্যান্টনি বুঝতে পারলেন, তাঁর বাবা পিটার রডরিক ইস্টন, যিনি সারাজীবন নিজেকে ইংরেজ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, আসলে জন্মেছিলেন প্রাক-যুদ্ধ জার্মানির এক ধনী ইহুদি পরিবারে। এই স্যুটকেসই খুলে দেয় এক লুকানো ইতিহাসের দরজা—নাৎসি নিপীড়নে নিশ্চিহ্ন হওয়া এক সাম্রাজ্য, হারিয়ে যাওয়া শিল্পকর্ম আর বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদ।
ধনাঢ্য জীবনের ছবিগুলো
পুরনো সাদা-কালো ছবিগুলোয় ধরা পড়েছে এক জাঁকজমকপূর্ণ জীবন—চালকসহ গাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি, চাকর-চাকরানিতে ঘেরা উঠোন। একটি ছবিতে ১২ বছর বয়সী পিটার হাসছেন বন্ধুদের সঙ্গে, পেছনে উড়ছে নাৎসি পতাকা। অ্যান্টনি বলেন, “স্যুটকেসটা যেন অতীত থেকে বাড়ানো একটা হাত ছিল।”
লোহার সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার
নথিপত্র ঘেঁটে অ্যান্টনি খুঁজে পান এক নাম—‘হানশে ভেরকে’। অনুসন্ধানে জানা যায়, এটি ছিল তাঁর প্রপিতামহ হাইনরিখ আইসনারের প্রতিষ্ঠিত স্টিল কোম্পানি। বিশ শতকের শুরুতে হাইনরিখ ছিলেন জার্মানির অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী।।তাঁর প্রতিষ্ঠানের কারখানা ছড়িয়ে ছিল জার্মানি, পোল্যান্ড ও রাশিয়ায়। হাইনরিখের সংগ্রহে ছিল অসংখ্য সম্পদ ও শিল্পকর্ম, যার মধ্যে ছিল জার্মান শিল্পী হান্স বালুশেকের আঁকা বিখ্যাত চিত্র Eisenwalzwerk (Iron Rolling Mill) — বর্তমানে এটি বার্লিনের ব্রোহান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত।
নাৎসি নিপীড়ন ও সম্পত্তি হারানো
১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে, হিটলার ক্ষমতায় আসার পর, ইহুদি ব্যবসায়ী পরিবারগুলো একে একে টার্গেট হয়। ১৯৩৮ সালে হানশে ভেরকে কোম্পানিকে চাপের মুখে বিক্রি করতে বাধ্য করা হয় নাৎসি-সমর্থিত শিল্পগোষ্ঠী মানেসমানের কাছে। ইতিহাসবিদদের ভাষায় এটি ছিল একটি “জোরপূর্বক বিক্রয়”—নাৎসি শাসনের অধীনে ইহুদি সম্পদ লুটের বৈধ রূপ।একই সময়ে, পরিবারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মার্টিন হার্টিগ তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন সম্পদ রক্ষা করার। কিন্তু তিনি আইসনার পরিবারের নামেই থাকা বাড়িঘর ও জমি নিজের নামে স্থানান্তর করে নেন—এবং আর ফেরত দেননি।
প্রাণ বাঁচাতে পলায়ন
স্যুটকেসে পাওয়া ট্রেন টিকিট, লাগেজ ট্যাগ আর হোটেল রসিদে জানা যায়—আইসনার পরিবার ১৯৩৮ সালে জার্মানি ছেড়ে পালিয়ে যায়। চেকোস্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ড ঘুরে ১৯৩৯ সালে ইংল্যান্ডে পৌঁছায় তারা।= তবে তাদের অনেক আত্মীয় নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিহত হন। রুডলফ আইসনার—অ্যান্টনির দাদু—যুদ্ধের শেষদিকে ব্রিটেনে বন্দি অবস্থায় মারা যান।
দশকের পর অনুসন্ধান
অ্যান্টনি পরে এক পেশাদার তদন্তকারী নিয়োগ দেন পরিবারের হারানো সম্পদের খোঁজে। বিভিন্ন জার্মান আর্কাইভ ঘেঁটে জানা যায়, ব্রোহান মিউজিয়ামের Eisenwalzwerk চিত্রকর্মটি সত্যিই আইসনার পরিবারের ছিল। তবে চিত্রকর্মটি ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া এখনো জটিল আইনি জালে আটকে আছে। প্রমাণ করতে হবে—বিক্রয়টি নাৎসি নিপীড়নের কারণে হয়েছিল কি না।
এক উত্তরাধিকার, যা কেউ মুছে দিতে পারেনি
অ্যান্টনি বলেন, “আমার বাবা সারাজীবন এই অতীত লুকিয়ে রেখেছিলেন। হয়তো এটা তাঁর অপরাধবোধ, হয়তো বেদনা। স্যুটকেসটা ছিল তাঁর নীরব স্বীকারোক্তি।” একটি পুরনো ব্যাগ, কয়েকটি ছবি ও হাতে লেখা কিছু নোট আজ সাক্ষ্য দিচ্ছে—নাৎসি নিপীড়ন যতই নির্মম হোক, ইতিহাসের সত্য কখনো পুরোপুরি হারায় না।



