হিরো অফ দি ডে

অজপাড়াগাঁয়ের বিদ্যালয় বদলে দিলেন শিক্ষক শহিদুল

রাজবাড়ীদূর থেকে দেখে শিশু পার্ক কিংবা বিনোদনকেন্দ্র মনে হলেও এটি অজপাড়া গাঁয়ের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যে বিদ্যালয়টি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পেয়েছে। আর এই কৃতিত্ব অর্জনের পেছনের মূল কারিগর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো.শহিদুল ইসলাম।

বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের স্বাবলম্বী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ছিলো অবহেলিত। শহিদুল ইসলাম এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কয়েক বছরের মধ্যেই বদলে গেছে বিদ্যালয়ের পুরো চিত্র। এখন বিদ্যালয়ের পাসের হার শতভাগ।

শিক্ষক শহিদুল নিজের কাজের জন্য ২০১৯ সালে একবার দেশসেরা প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। সৎ ও আদর্শবান শিক্ষার্থী গড়ে তুলতে নিজ উদ্যোগে স্কুলে ‘সততা স্টোর’ চালু ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ঠেকাতে ‘বন্ধু টিম’ এর মতো ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে তিনি রীতিমতো সাড়া ফেলে দেন দেশব্যাপী। বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের যেন পরম মমতায় আগলে রেখেছেন তিনি।

শহিদুল ইসলামের বাড়ি বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে বাড়াদি গ্রামে। সংসারে তার মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে ওয়ালিদ হাসান (২২) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়েন। ছোট ছেলে খালিদ হাসান স্থানীয় বহরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

জানা গেছে, বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের বাড়াদি গ্রামের ১৯৬৮ সালে ৩৩ শতাংশ জমির ওপর একটি টিনের ছাপরা ঘরে স্বাবলম্বী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০ জন শিক্ষার্থী ও চারজন শিক্ষক নিয়ে বিদ্যালয়টি তখন চালু হয়। কিন্তু ফলাফল তেমন ভালো হতো না।১৯৮৪ সালে জাতীয়করণের পরও পিছিয়েই ছিল বিদ্যালয়টি।

২০০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে স্নাতকোত্তর করা শহিদুল ইসলাম। তখন শিক্ষার্থী ছিল ১২৫ জন। যোগদানের পর পড়াশোনার দুর্দশা দেখে হতাশ হন। কিন্তু তিনি দমে জাননি। বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো করার জন্য ও বিদ্যালয়কে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি নিরলসভাবে কাজ করেছেন।

সরকারি অনুদানের অর্থের অভাবে উন্নয়নমূলক কাজ আটকে যায়। শহিদুল নিজের সম্পত্তি বেচে, বাড়ির গাছ বেঁচে, ঋণ নিয়ে ও বেতনের সিংহভাগ টাকা দিয়ে সেই কাজ চালিয়ে যান। এখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত ভাবে সাড়ে ১৪ লাখ টাকা খরচ করেছেন স্কুলের পেছনে। ধীরে ধীরে পড়াশোনার মান বাড়তে থাকেন স্কুলের। ২০০৫ সালে বিদ্যালয়টি উপজেলায় সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

২০০৬, ২০১২ ও ২০১৬ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন শহিদুল। ২০১৯ সালে ঢাকা বিভাগে ও সারা দেশে সেরা প্রধান শিক্ষক হন তিনি। তার ঐকান্তিক চেষ্টায় ২০১৭, ২০২২ ও ২০২৪ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয় স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০২৪ সালে ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায় এবং প্রাথমিক শিক্ষা পদকের শ্রেষ্ঠ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্যায়ে বিদ্যালয়টি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। এ বছর শিক্ষক শহিদুল রাজবাড়ীর শ্রেষ্ঠ গুণী  শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন।

বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র শিক্ষা নয়, সৎ চরিত্র, আদর্শ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষক শহিদুল ইসলাম ২০১৫ সালে বিদ্যালয়ে ‘সততা স্টোর’ নামে একটি বিক্রেতা বিহীন দোকান চালু করেন। বিদ্যালয়ের একটি স্থানে শিক্ষা উপকরণ ও বিভিন্ন খাবারের আইটেম রাখা হয়। বিভিন্ন পণ্যের গায়ে দাম লেখা থাকে। আর শিক্ষার্থীরা এসে দাম পরিশোধ করে পণ্য নিয়ে যেত। এটি বাংলাদেশের মধ্যে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। সেসময়।শিক্ষার্থীরা সততার পরিচয় দিয়ে বিক্রেতা বিহীন দোকান থেকে পণ্য ক্রয় করে থাকে।

স্বাবলম্বী স্কুলে তিনটি গ্রামের ৪৮১ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। গ্রামগুলোকে কয়েকটি পাড়ায় বিভক্ত করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ২০২৪ সালে প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম ‘বন্ধু টিম’ গঠন করেন। বন্ধু টিমের সদস্যরা প্রতিদিন একসঙ্গে বিদ্যালয়ে আসে। একত্রেই আবার ফেরে। বন্ধুদের পড়াশোনায় একে অন্যকে সহায়তা করে। প্রত্যেক দলে একজন করে দলনেতা রয়েছে। দলের কেউ বিদ্যালয়ে আসতে না পারলে দলনেতা শিক্ষকদের কাছে জানায়। প্রয়োজনে দলের সদস্যরা কিংবা শিক্ষক নিজে গিয়ে শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন বা খোঁজখবর নেন।

বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানো, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ঠেকাতে, নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশে, সহযোগিতার মনোভাব তৈরিতে বন্ধু টিম বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এই উদ্ভাবনের জন্য স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষক শহিদুলকে সম্মাননা জানানো হয়। গত বছরের ২৪ অক্টোবর নায়েম (ন্যাশনাল একাডেমি ফর এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট) ও ইউনেসকো যৌথভাবে এই সম্মাননা দেয় তাকে।

এভাবেই বালিয়াকান্দির স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে দেশসেরা পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। তিনি প্রমাণ করেছেন— একজন সৎ, আদর্শবান ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক চাইলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যেমন বদলে দিতে পারেন, তেমনি বদলে দিতে পারেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনও।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker