যতই বেলা বারছিল, সুর্যের তাপ ততই বারছিল। আমরা খাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নিয়ে রংরাং থেকে আমরা যাত্রা করলাম খ্যামচং পাড়াার দিকে। আবারো খাড়া পাহাড়ের ধার বেয়ে নিচে নেমে আসা। চুড়া থেকে নিচে নেমে প্রথমেই আমরা যে যার ব্যাগ নিয়ে নেই। ব্যাগ পিঠে চাপাতেই ট্রেকিং এর কষ্ট দিগুন হয়ে গেল, এক একটি ব্যাগের ওজন ৩০ থেকে ৩৫ কেজি, মাসল ক্রাস্প নিয়ে এতো ভাড়ি ব্যাগ নিয়ে হাটাটা আমার জন্য বেশ কঠিন ছিলো। প্রথম বিশ্রামের সময় উসাই এর ব্যাগটা হাতে নিয়ে ওজন পরীক্ষা করে দেখলাম। ওর ব্যাগের সাইজ ছোট ও ওজনে কিছুটৃ কম, আমি দেরী না করে উসাই এর সাথে ব্যাগ পরিবর্তন করে নিলাম। মাসল ক্রাম্পের রূগী হিসেবে এই সুযোগটা আমি নিতেই পারি।
সূর্য মাথার উপর উঠে গেছে, রোদের তেজ ও বেশ ভালই, ঘন জঙ্গল হলেও সুর্যের তাপ ভালোই বোঝা যাচ্ছিলো। তার উপর গাছের ডাল ও লতায় পা আটকে যাচ্ছিলো। ঘন জঙ্গলের মধ্যে পথ চিনিয়ে চিনিয়ে গন্তব্যে নিয়ে যাচ্চিলো ল্যাং মুরং। এই পথে লোকজনের চলাচল কম থাকায় পায়ে চলার রাস্তা স্পষ্ট না। মাঝে মাঝেই সন্দেহ হচ্ছিলো ঠিক পথে আছি তো? সব মিলে ট্রেকিং করতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো। তাই সুযোগ পেলেই কিছুক্ষণ পরপরই বিশ্রাম আর সংগে যা আছে সেখান থেকে হালকা খানাপিনা।
কিছুদুর সামনে যেতেই এক অপরূপ সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করে দিলো। চারিদিক যেন লাল রঙে ছেয়ে গেছে, বনের মধ্যে এত সুন্দর লাল ফুল, মনে হচ্ছে কেউ যেন বনের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সকলে এগিয়ে গেলেও আমি থেমে গেলাম। এই পাগল করা বুনো সৌন্দর্য্য আমাকে আর এগুতে দিচ্ছিলো না। নাম জানি না, চিনি না, সবগুলো ফুলই আমার অচেনা। একটা ফুল কিছুটা পারিজা ফুলের মতো। পারিজা নামটা রবিন্দ্রনাথের দেওয়া, স্থানীয় নাম সম্ভবত মান্দা বা মাদার। হতে পারে এই ফুলগুলো পারিজার পাহাড়ী জাত। পরে গাইড ল্যাং মুরং কে ফুলগুলোর নাম জানতে চাইলাম। পাহাড়ে মনে হয় কোন ফুলের নাম হয় না, সবই হয় জংলি ফুল নাহয় পাহাড়ী ফুল। বীর বাহাদুর থেকে লেং মুরং পর্যন্ত কেউই জংলি বৃত্তটা ভাঙতে পারল না। এই পাহাড়ি ফুলগুলো অচেনা হলেও এর সৌন্দর্য্য যেন কত দিনের চেনা, কত আপন। এর মাঝে এক চৌম্বকীয় শক্তি আছে যা আপনার দৃষ্টি ওর দিকে নিবদ্ধ করে রাখতে বাধ্য করবে। আর এই লাল ফুলগুলো থেকে লাল রঙ বের হয়ে এসে গাছপালা, বন, পাহাড়, এমনকি দুপুরের সোনলী রোদকেও যেন লাল রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে।
হাসান ভাইয়ের ডাকে সম্বিত ফিরল, আমাদের দল অনেক সামনে চলে গিয়েছে, দ্রুত লয়ে পা চালিয়ে দলের সাথে যোগ দেই। খ্যামচং পাড়ার পথে বিরাট বড় বড় গাছ আর ঘন জঙ্গল থাকলেও, মাঝে মাঝেই বেশ ফাকা পাহাড় পার হতে হচ্ছিল। আমরা যারা দুপুর রোদে খাড়া পাহারে ট্রেকিং এ অভ্যস্থ নই তাদের জন্য ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। পাহাড়ের কড়া রোদ আমাদেও ক্লান্ত করে দিচ্ছিল অতি দ্রুত, তারপরও আমরা দ্রুত হাঁটছি আমাদের গন্তব্যে।
ঘড়িতে তখন সম্ভবত ১২ টা ১৫, দূরে সবুজ টিনের একটি চাল দেখা যায়, আমরা বুঝতে পারি খ্যামচং পাড়া আর বেশি দুরে নেই।