জেলার খবর

ভিক্ষুক নয়া বেগমের এখন পরিচয় দোকানদার নয়া বেগম

২৬৩২৩+“মাও দুইটা টাকা দেন, আল্লাহর ওয়াস্তে দুইটা টাকা দেন, বাড়িতে আছেন মা-দুইটা টাকা ভিক্ষা দেন” শুক্রবার আসলেই এরকম বিভিন্ন স্লোকে মুখরিত হত নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার প্রতিটি দোকান ও বাড়ি। একজনকে ভিক্ষা না দিতেই আর একজন চলে আসতো বাড়িতে। দোকানের সামনে ভিক্ষুকের লাইন হতো। হাত পেতে ভিক্ষা নিতো ভিক্ষুকরা। বর্তমানে ওই হাতেই ক্রেতাকে দিচ্ছে পণ্য আর হাত দিয়েই নিচ্ছে পণ্য বিক্রয়ের মূল্য। ভিক্ষুকের হাতগুলো কর্ম, উন্নয়ন ও উদ্যোক্তার হাতে পরিণত হয়েছে। ঘুড়ে দাড়ানো আর মাথা গোঁজার ঠাই পেয়েছে এ সকল ভিক্ষুকরা। তাদের কর্মের প্রত্যয়, উপজেলা পরিষদ-উপজেলা প্রশাসনের পরিকল্পনা আর সহযোগিতা, সরকারের পরিকল্পনা আর অর্থায়নে পুনর্বাসিত ভিক্ষুক দোকানের মালিক। ভিক্ষুক নয়া বেগমের এখন পরিচয় দোকানদার নয়া বেগম।

নয়া বেগম পেশায় একজন ছিলেন ভিক্ষুক। মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে ভিক্ষা করে অসুস্থ্য এক মেয়ে আর অসুস্থ্য স্বামীকে নিয়ে কোন রকমে সংসার চালাতেন। স্বামীর অসুস্থ্যতায় ভিক্ষা পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভিক্ষা করে জীবন নামের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। ২০১৪ সালে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় উপজেলা প্রশাসন। সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টুনির আওতায় আসে ভিক্ষুকরা। এছাড়া দেয়া হয় সরকারি বিভিন্ন সহযোগিতা। এর ফলে নয়া বেগম ঘুরে দাড়াতে শুরু করে। সম্প্রতি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের অর্থায়নে ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসুচির আওতায় ক্ষুদ্র ব্যবসা মুদির দোকান পায় পুনর্বাসিত নয়া বেগম। তাকে বরাদ্দকৃত ৫০ হাজার টাকা দিয়ে একটি দোকান ঘর ও বিভিন্ন উপকরণ (পণ্য) ক্রয় করে দেয়া হয়। এটির বাস্তবায়ন করে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা সমাজ সেবা কার্যালয়। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুড়া থেকে কিশোরগঞ্জ মূল সড়কের পাশেই গাড়াগ্রাম সরকারপাড়া এলাকায় তার দোকানটি। সেই হাত পেতে খাওয়া ভিক্ষুক নয়া বেগম এখন ওই হাতেই পণ্য বিক্রয় করছে। হয়েছে দোকানের মালিক।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়- বিদ্যুতের বাতির আলোতে আলোকিত দোকানটি। দোকানের ভিতরে বসে আছে নয়া বেগম। দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে আছে ৩ জন ক্রেতা। কেউ পান নিচ্ছে, কেউ বা বিস্কুট খাচ্ছে। রাস্তার পথচারীরা দাড়িয়ে খরচ নিচ্ছে। এরপরেই পার্শ্ববতী বাড়ির গাড়াগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া জান্নাতি এসে কয়েল চাইলে নয়া বেগম কয়েল বের করে দিল এবং কয়েলের দাম নিল দু হাত বাড়িয়ে। এ হাত দু’টি যে এক সময় ভিক্ষা করতো না জানা কেউ বিশ্বাস করবেই না। ভিক্ষুকের হাতগুলো যে কর্ম, উন্নয়ন, স্বাবলম্বী ও উদ্যোক্তার হাতে পরিণত হয়েছে তার দৃষ্টান্ত নজির নয়া বেগম। এভাবেই প্রতিদিন বিকিকিনি করছে এক সময়ের ভিক্ষুক নয়া বেগম। এসময় নয়া বেগমের সাথে কথা হলে তিনি- এ প্রতিবেদককে জানান মানুষের কাছে হাত পেতে বাবা খাছনু। কি যে কষ্ট। দূর দূরান্ত হেটে হেটে ভিক্ষা করছু। তাও মাঝে মধ্যে উপাস থাকির নাগছে। এখন আর উপাস থাকির নাগে না। সকাল আর রাইতোত করি খাবার পাওছো। সরকার সুযোগ সুবিধা দেয়ছে দেখি দুই বেলা খাবার পাওছোন বাবা। মোর স্বামী অসুস্থ্য, চলিবার পায় না। সরকার এই দোকান আর বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা দেয়ায় আর ভিক্ষা করিবার নাগে না। দিনে কত টাকা আয় হয় প্রশ্ন করলে নয়া বেগম বলেন- বাবা দিনে ২০০-৩০০ টাকা আয় হয়। কষ্ট করিয়া দিন চলি যায়। এসময় চোখের ভিতরে পানি টলমল করছে যেনো বেয়ে পড়বে। ছলছল চোখ দু’টি থেকে পানি পড়তে থাকে আর তিনি বলতে থাকেন “শেখের বেটি হামার জন্য অনেক করেছে, গরীব মানুষগুলার সাহায্য করেছে, হামার জন্য দোকান-বাড়ি করি দেয়ছে”। শেখের বেটিক যদি সামনাসামনি দেখিবার পানু হায়। মোর খুব শখ শেখের বেটিক দেখিবার। মুই প্রতিদিন শেখের বেটির জন্য দোয়া করো।
সত্যিই হাত বাড়ানো ভিক্ষুকের হাত উদ্যোক্তার হাতে পরিণত হয়েছে। সকালে দোকান খুলে আর রাতে বন্ধ করে। মালামাল বিক্রির মূল টাকা দিয়ে প্রতিদিন মালামাল কিনে আনছে আর লাভের টাকা দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন নয়া বেগম। নয়া বেগমের চোখে ঘুড়ে দাড়ানোর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছে। মুখের হাসি বলছে এ ভিক্ষুক নয়া বেগম নয়, এ যেন দোকানের মালিক নয়া বেগম, স্বাবলম্বী আর নিজের পায়ে দাড়ানো নয়া বেগম।

নয়া বেগম আনন্দিত কন্ঠে এ প্রতিবেদককে বলেন- ব্যাহে ইএনও (ইউএনও) স্যার কিশোরগঞ্জ থাকি মোর দোকানোত আটা কিনবার আসছেলো। ২ প্যাকেট আটা কিনে নিয়ে গেইছে। মুই খুব খুশি যে, মোর দোকানের কাস্টমার ইএনও (ইউএনও) স্যার। তিনি আরও জানান- ব্যাহে দোকানের দুই প্যাকে বেঞ্চ, ১ টি চা রাখার ফ্যালাক্স আর ১ টা ফ্রিজ দিলে মোর ব্যবসা আরও চাংগা হইবে। মুই স্যারক কছু। তোমরা এনা কইলেন হায়।
সম্প্রতি ঢাকা থেকে ছুটে আসেন তৎকালীন ইউএনও মোঃ সিদ্দিকুর রহমান। যার অক্লান্ত চেষ্টা আর অদম্য মনোবল-পরিকল্পনায় নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলাকে ২০১৪ সালের ৫ জুলাই ভিক্ষুক মুক্ত উপজেলা ঘোষণা করা হয়। দেশের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে এ উপজেলা। যাকে বিভিন্ মিটিয়া বিভিন্ন শব্দে আখ্যায়িত করেছে। কেউ বলেছে ভিক্ষুক স্যার আবার কেউ বলেছে মানবতার ফেরিওয়ালা। ওই মানবতার ফেরিওয়ালার হাতেই উদ্বোধন হয় পুনর্বাসিত নয়া বেগমের মুদি দোকানটি। এতে সৌভাগ্য মনে করছে নয়া বেগম। ওই স্যারকে পেয়েও কেঁদে ফেলেন নয়া বেগম। কারণ তারসহ এ উপজেলার ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন করেছেন এবং ঘুরে দাড়ানোর স্বপ্ন যে ওই ইউএনও’ই তাদের দেখিয়েছেন। উদ্বোধনের সময় উপস্থিত ছিলেন ভিক্ষুক পুনর্বাসন কার্যক্রমটির বর্তমান টেকসই দাতা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম বাবু, গাড়াগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান জোনাব আলী, ইউএনও অফিসের আইয়ুব আলী, সমাজসেবা অফিসের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক প্রমুখ। পরে তিনি উপজেলা প্রশাসন সভা কক্ষে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে পুনর্বাসিতদের জীবনমান নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকদের নিয়ে মতবিনিময় করেন।

মানবতার ফেরিওয়ালা তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সিদ্দিকুর রহমান কিশোরগঞ্জে যোগদান করেই ভিক্ষুকমুক্ত উপজেলা ঘোষণা ও তাদের পুনর্বাসনের কাজে হাত দেন। কর্মসংস্থান, সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রদান, সহযোগিতা, মৌলিক চাহিদাসহ আর্থিক ও সামাজিক ভাবে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে করেন ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা পুনর্বাসন কমিটি। এ কমিটিতে সকল পেশার মানুষদের সম্পৃক্ত করে ২০১৪ সালের ৫ জুলাই এ উপজেলাকে দেশের প্রথম ভিক্ষুকমুক্ত উপজেলা ঘোষণা করা হয়। এসময় ভিক্ষুকদের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়। ডাটাবেজকৃত ৯৮৯ ভিক্ষুকদের চাহিদা মোতাবেক ক্ষুদ্র ব্যবসা, ছাগল-হাঁস-মুরগি পালন, পিঠার দোকান, সবজি দোকানসহ বিভিন্নভাবে পুনর্বাসন করা হয়। এদেরকে সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনির আওতায়ও আনা হয়। দেয়া হয় বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড। অর্ন্তভূক্ত করা হয় ৪০ দিনের কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে। এছাড়াও পুনর্বাসিত ভিক্ষুকদের বিভিন্ন ভাবে কর্মমুখী মূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। এছাড়াও দেয়া হয় প্রতিটি ঈদে ভিজিএফের চালসহ ঈদ বোনাস (নগদ ১০০ টাকা, দুই প্যাকেট সেমাই, এক কেজি চিনি, শাড়ি লুঙ্গি, গরুর মাংস)। এদের মধ্যে ৯৫১ জনকে ১২ টি স্পেশাল সমিতির মাধ্যমে “একটি বাড়ি, একটি খামার” প্রকল্পের সদস্য করে দেয়া হয় ঋণ।

ঋণের টাকা দিয়ে গরু, ছাগল ও ব্যবসা করে তারা স্বাবলম্বী হতে থাকে। মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে খাওয়া মানুষগুলো কর্মের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি এক এক জন উন্নয়ন কর্মীতে রূপান্তরিত হয়। কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুনর্বাসিতদের সাফল্যের কথা শুনে সরজমিনে এর বাস্তব চিত্র দেখার জন্য আসেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন মুখ্য সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ। তিনি এদের পুনর্বাসনের বাস্তবতা চিত্র দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এছাড়াও ভিক্ষুক পুনর্বাসন কার্যক্রম দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদ সচিব শফিউল আলম। তিনি রনচন্ডী স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে ভিক্ষুকদের কার্যক্রম পরিদর্শন ও তাদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।
অন্যদিকে পুনর্বাসিত ভিক্ষুকদের ঘর উপহার দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ‘যার জমি আছে ঘর নাই তার নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ’ উপখাতের আওতায় এ উপজেলার ৬৯১ জন ভিক্ষুককে ঘর উপহার দেয়া হয়।

পুনর্বাসিত ভিক্ষুকরা মাথা গোজাঁর ঠাই পেয়েছে, বাঁচতে শিখেছে, কর্ম করতে শিখেছে, চলতে শিখেছে, উন্নয়ন করতে শিখেছে, উন্নয়নের রুপকারে পরিণত হয়েছে। হচ্ছে স্বাবলম্বী। ভিক্ষা করা হাত গুলোই হচ্ছে দোকান মালিকের হাত। ভিক্ষুক নয়া বেগম আজ গর্বিত দোকান মালিক। নয়া বেগমের মত আরও ৪৭ জন ভিক্ষুককে অল্পকিছু দিনের মধ্যে দোকান করে দেয়া হবে বলে উপজেলা প্রশাসন এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন। নয়া বেগমসহ এ উপজেলায় সরকারিভাবে ৪৮ জন পুনর্বাসিত ভিক্ষুক হবে দোকানের মালিক।

উপজেলা সমাজসেবা অফিসার জাকির হোসেন জানান- নয়া বেগমের দোকান চালু করা হয়েছে। ভালই চলছে। আমরা বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ থেকে ৪৮ টি মুদি দোকান দেয়ার বরাদ্দ পেয়েছি। প্রাথমিকভাবে ১ টি চালু করা হয়েছে। এটি মনিটরিং করে কিভাবে সম্ভাবনাময় স্মার্ট মুদি দোকান দেয়া যায়, সেভাবে পরবর্তী দোকানগুলো চালুর উদ্দ্যোগ নিয়েছি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী এ প্রতিবেদককে জানান- এ কার্যক্রমটি বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করা হচ্ছে ও হবে। যাতে এটি টেকসই হয়।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button