হান্টার সিনড্রোমে বিশ্বে প্রথম জিন থেরাপি সফল—অলিভারের জীবনে আশার আলো
দুর্লভ ও প্রাণঘাতী জিনগত রোগ হান্টার সিনড্রোমে আক্রান্ত তিন বছর বয়সী এক শিশু চিকিৎসা-বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ব্রিটিশ চিকিৎসা সেবার অন্যতম বৃহৎ কেন্দ্র রয়্যাল ম্যানচেস্টার চিলড্রেন’স হাসপাতাল প্রথমবারের মতো জিন-পরিবর্তন প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিশুটির অবনতি থামাতে সক্ষম হয়েছে। বিবিসি ২৪ নভেম্বর ২০২৫ তারিখের এক প্রতিবেদনে ঘটনার পুরো বিবরণ প্রকাশ করেছে ।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা অলিভার চু, যার শরীরে একটি ত্রুটিপূর্ণ জিনের কারণে প্রয়োজনীয় আইডুরোনেট–২–সালফাতেস (IDS) এনজাইম তৈরি হতো না, সেই এনজাইম তৈরির ক্ষমতা এখন তার শরীরেই ফিরে এসেছে। এই এনজাইম না থাকলে শিশুর শরীর ও মস্তিষ্কে বিষাক্ত উপাদান জমে ধীরে ধীরে দেহের নানা অঙ্গ নষ্ট হয়ে যায়।
চিকিৎসায় এক বৈপ্লবিক অগ্রগতি
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, হান্টার সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত ২০ বছরের বেশি বাঁচে না এবং অনেকের ক্ষেত্রে মানসিক সক্ষমতা দ্রুত ক্ষয়ে যায়—যা “শৈশব ডিমেনশিয়া” হিসেবেও পরিচিত।
এই দীর্ঘদিনের অনিরাময়যোগ্য রোগের বিরুদ্ধে এবার প্রথমবার পরীক্ষা করা হলো একবারের জিন থেরাপি—যার ফলাফল গবেষকদের ভাষায় “অসাধারণ।”
গবেষণার সহনেতা প্রফেসর সাইমন জোন্স বিবিসিকে বলেন,
“দুই দশক ধরে এমন এক শিশুর অপেক্ষায় ছিলাম—যার অবস্থার এত দ্রুত উন্নতি দেখা যাবে।”
চিকিৎসা–পদ্ধতির যাত্রা
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ম্যানচেস্টারের গবেষণা কেন্দ্রে অলিভারের দেহ থেকে বিশেষ ধরনের স্টেম সেল সংগ্রহ করা হয়।
পরে লন্ডনের গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট হাসপাতালে সেলগুলোকে জিন-সম্পাদনার মাধ্যমে নতুন করে প্রোগ্রাম করা হয়—যাতে সেগুলো সন্তানকে প্রয়োজনীয় এনজাইম তৈরি করতে সাহায্য করে।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঐ কোষগুলো অলিভারের দেহে ফেরত দেওয়া হয়। কেবল দশ মিনিটের ইনফিউশনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় চিকিৎসার মূল ধাপ—কিন্তু এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি।
অবিশ্বাস্য উন্নতি
তিন মাস পরই দেখা যায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
অলিভার—
- আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়
- কথা বলায় বেশ অগ্রগতি সাধন করেছে
- এখন সাচ্ছন্দে চলাফেরায় সক্ষম
- এর এখন আর সাপ্তাহিক এনজাইম ইনফিউশনের প্রয়োজন নেই
তার মা জিংরু বলেন,
“যখন ভাবি, সে এখন নিজের শরীরেই এনজাইম তৈরি করছে—তখন আবেগ চাপা রাখা কঠিন।”
দুই ভাইয়ের আশা ও লড়াই
অলিভারের বড় ভাই স্কাইলারও একই রোগে আক্রান্ত।
স্কাইলারের বয়স বেশি হওয়ায় তার মস্তিষ্কে ইতিমধ্যে কিছু ক্ষতি দেখা গেছে—তাই সে এখনো পুরোনো ইনফিউশন থেরাপির ওপর নির্ভরশীল।
তাদের বাবা রিকি বলেন,
“যদি স্কাইলারও একদিন একই চিকিৎসা পেতে পারে—তা হলে সেটাই হবে আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় স্বপ্নপূরণ।”
দুর্লভ রোগ চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে আরও চারটি দেশে মোট পাঁচজন শিশুর ওপর এই ট্রায়াল চলছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, দুই বছর ধরে এসব শিশুদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
যদি ফল সাফল্যমণ্ডিত হয়, তবে এই জিন থেরাপি হবে বিশ্বের প্রথম অনুমোদিত চিকিৎসা—যা হান্টার সিনড্রোমের অগ্রগতি থামিয়ে দিতে পারে।
গবেষণা তহবিল সংকটে পড়ে একসময় এই ট্রায়ালই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। পরে ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা লাইফআর্ক জরুরি সহায়তায় প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করে।
অলিভারের নতুন জীবন
চিকিৎসকদের ভাষায়, চিকিৎসার নয় মাস পর এখন অলিভারের মস্তিষ্ক ও শরীর দুটোই স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হচ্ছে।
প্রফেসর জোন্স সতর্ক আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন,
“এখন পর্যন্ত যা দেখছি—তা সত্যিই আশাপ্রদ।”
রিকি চু বলেন,
“একসময় হাসপাতাল আর সূচ ছিল তার প্রতিদিনের অংশ—এখন সে দৌড়ে বেড়ায়, কথা বলে, শেখে। যেন নতুন জীবন পেয়েছে।”



