জলবায়ু পরিবর্তনবিদেশ

সাগরমাতার ছায়ায় জলবায়ুর পাঠ: পর্বতের কণ্ঠস্বর এবার বিশ্বমঞ্চে

সাগরমাতা সংবাদকাঠমান্ডুর আকাশে মে মাসের নরম রোদ যখন মৃদু তুষারের স্মৃতি ভিজিয়ে দিচ্ছিল, তখন রাজধানীর ব্যস্ত অলিগলির মাঝেও যেন হিমালয়ের নিঃশব্দ উপস্থিতি অনুভব হচ্ছিল। ঠিক এমন এক মুহূর্তেই, ১৬ থেকে ১৮ মে, ‘সাগরমাতা সংবাদ’ নামে এক অভিনব বৈশ্বিক সংলাপের অবতারণা করল নেপাল—একটি ছোট, পার্বত্য দেশ, যার কণ্ঠ এতদিন বিশ্ব জলবায়ু আলোচনায় চাপা পড়ে ছিল।

এই অনুষ্ঠান যেন শুধু কূটনৈতিক এক আয়োজন নয়, বরং ছিল এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ, এক আবেগভরা আহ্বান—পর্বতের গলিত হৃদয় থেকে বিশ্ব মানবতার উদ্দেশে। হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া সাগরমাতার নামে নামাঙ্কিত এই সংলাপের কেন্দ্রে ছিল একটি চিরন্তন প্রশ্ন—আমাদের ভবিষ্যৎ কি এই বরফগলা পাহাড়ের সাথে গলে যাবে?

নেপালের দীর্ঘ পরিকল্পনা ও মহামারীজনিত বিলম্বের পর, ২০২৫ সালের এই আয়োজন ছিল আন্তর্জাতিক জলবায়ু আলোচনায় পার্বত্য উদ্বেগগুলিকে সম্মান জানানোর এক কূটনৈতিক প্রতিজ্ঞা। ‘জলবায়ু পরিবর্তন, পর্বতমালা ও মানবজাতির ভবিষ্যৎ’—এই প্রতিপাদ্যে গঠিত সাগরমাতা সংবাদে যোগ দিলেন ১২টি দেশ থেকে শতাধিক বিদেশি প্রতিনিধি, পরিবেশবিদ, আদিবাসী নেতা, তরুণ কর্মী ও কূটনীতিকেরা। কাঠমান্ডুর দ্য সলটি হোটেলে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি বললেন, “পর্বতমালাকে রক্ষা করা মানে মানবতাকে বাঁচানো।”

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ভিডিও বার্তা এই বার্তাকেই আরও গভীরতা দেয়। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, হিমালয় গড় বৈশ্বিক হারের দ্বিগুণ গতিতে উষ্ণ হচ্ছে—একটি নিঃশব্দ বিপর্যয়, যা লক্ষ লক্ষ জীবনের জলের যোগান ও জীবিকার ভরসা কেড়ে নিচ্ছে।

সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে উঠে আসে হিমবাহ সংরক্ষণ, প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান, সবুজ অর্থনীতি, লিঙ্গ ন্যায়বিচার এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রসঙ্গ। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল শিশু ও তরুণদের অংশগ্রহণ, যারা ‘বায়ু সংবাদ’ ও ‘জুংলায় হিমালয় সংলাপ’-এর মাধ্যমে তাদের সরাসরি অভিজ্ঞতা ও দাবি বিশ্বদরবারে তুলে ধরেন। যেন হিমবাহের গলনের সঙ্গে সঙ্গে গলে পড়ে তাদের শিশুকণ্ঠে ভবিষ্যতের এক অনিবার্য আকুতি।

১৮ মে, সর্বসম্মতভাবে গৃহীত “সাগরমাতা কর্মের আহ্বান”—একটি ২৫ দফার ঘোষণা—বিশ্ব জলবায়ু নীতিতে পার্বত্য সমস্যাগুলিকে সামনে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। এখানে অন্তর্ভুক্ত ছিল একটি ‘হিমালয়ান ক্লাইমেট ফান্ড’-এর প্রস্তাব, ১.৫°C লক্ষ্য পূরণের অঙ্গীকার, এবং এলডিসি ও পার্বত্য রাষ্ট্রগুলির জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধানের আহ্বান।

তবে এই আশাবাদের মাঝেও কিছু অপূর্ণতার  ছায়া রয়ে গেছে। রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানদের অনুপস্থিতি, ত্বরিত আঞ্চলিক কাঠামোর অভাব এবং নেপালের অভিজ্ঞ আলোচকদের যথাযথ ব্যবহার না হওয়া—সব মিলিয়ে এই আয়োজন একটি ‘অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি’র মতো থেকেও যেতে পারে।

তবু, ‘সাগরমাতা সংবাদ’ নিছক একটি সম্মেলন ছিল না—এটি ছিল এক উচ্চতা থেকে ভেসে আসা একটি সতর্ক বার্তা, এক সাহসী দাবি: পার্বত্য মানুষেরাও জলবায়ু ন্যায়ের ভাগীদার। হয়ত তাদের কণ্ঠস্বর এতদিন অশ্রুত ছিল, কিন্তু এবার সাগরমাতার ছায়ায় সেই কণ্ঠ বিশ্ব জলবায়ু সংলাপে গেঁথে গেল চিরস্থায়ী শব্দরূপে।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button