ভোগান্তি চরমে, তবুও বিচার চায় ঘাতকের
সত্তরোর্ধ্ব আলিমুজ্জামান ঘাড়েও ব্যাগ, হাতেও। উত্তরার জসীম উদ্দীন থেকে হেঁটে খিলক্ষেতের ঢাকা রিজেন্সি’র সামনে অবস্থান নেন। যানবাহনের কমতি ছিল না সড়কে। কিন্তু সবই স্থবির! দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় বিচারের দাবিতে উত্তরায় চলছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। রাস্তা অবরোধের কারণে কোনো যানবাহন চলছিল না। যে কারণে হেঁটেই আসা। গন্তব্য তার তেজগাঁও তেজকুনি পাড়া।
বৃদ্ধ আলিমুজ্জামান চায়ের দোকানে বিরতি নেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলছিলেন, ‘আমগো কষ্ট হইলেও ছাত্রদের অবরোধের দরকার ছিল। হেই ব্যাডারা (চালক-হেলপার) মানুষ পিইষা মাইরা ফালাইতেছে, কিন্তু বিচার হইতেছে না। হেল্লাই তো পোলাপাইন রাস্তায় খাড়াইছে, অবরোধ করতাছে। গাড়ি ভাঙতাছে। আমার মতো বহুত লোকই তো হাইট্টা চলতাছে। কষ্ট পাইতাছি। কিন্তু কোল যার খালি হইছে হেই তো বেশি কষ্টে। বিচারডা জরুরি।’
শুধু আলিমুজ্জামান নয়, মঙ্গলবার দিনভর লাখো মানুষ পড়েন ভোগান্তিতে। দিনভর প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ সূত্রে ও সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, সকাল থেকেই উত্তাল রাজধানী। নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ, নিরাপদ সড়ক ও ঘাতক চালকদের দ্রুত বিচার ও ফাঁসির দাবিতে সকাল ১০টা থেকে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ধীরে ধীরে ফার্মগেইট, সাইন্সল্যাব, মতিঝিল, মিরপুর, উত্তরা, আগারগাঁও, বাড্ডা ও রামপুরা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট সব এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশ নেয়। রাস্তা অবরোধ করে, কোথাও লাঠিপেটা করে পুলিশ, একাধিক বাস পোড়ানো, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ঘটে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাও
সকাল থেকে রাজধানীর ফার্মগেটের সড়কে অবরোধ করেন সরকারি বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফার্মগেট ওভারব্রিজের নিচে শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে প্রায় দুই ঘণ্টা কারওয়ান বাজার থেকে বিজয় সরণির দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ ছিল। বেলা সাড়ে ১১টায় মিরপুর-১ নম্বর সড়কে অবস্থান নেন ঢাকা কমার্স কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা দু’টি বাসে ইটপাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর চালান। মিরপুর-১০ নম্বর চত্বরে ও আগারগাঁও এলাকাও অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা।
দুপুর ১টা থেকে উত্তরার কয়েকটি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা উত্তরার জসীম উদ্দীন মোড়ে অবরোধ করে। এ সময় পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে তাদের কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অবরোধের ফলে উত্তরা-বিমানবন্দর সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকেল সাড়ে ৩টায় জসীম উদ্দীন রোড়ে উত্তরা ইউনির্ভাসিটি, মাইলস্টোন কলেজ, স্কলাসটিকাসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে। এ সময় এনা ও বুশরা পরিবহনের দু’টি বাসে আগুন দেয়।
দুপুর ১২টা থেকে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। প্রায় কয়েকশ’ শিক্ষার্থীর সড়ক অবরোধের কারণে শাপলা চত্বরে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষোভ স্লোগানের এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা একটি বাস ভাঙচুর করে।
দুপুর পৌনে ১২টার দিকে সাইন্সল্যাব মোড়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে সিটি কলেজ এবং ধানমন্ডি আইডিয়ালসহ বেশ কয়েকটি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে মিরপুর রোড, নীলক্ষেত এবং শাহবাগ থেকে সাইন্সল্যাব এলাকার যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের অবরোধ ভেদ করে একটি বাস সাইন্সল্যাব মোড়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ এলাকায় শিক্ষার্থীরা বাস অবস্থান নেয়। বিভিন্ন বাসের চালকের লাইসেন্স আছে কিনা জানতে চায় শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে? নাই বললেই সে বাস আর গাড়ি যাবে না। যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে বাস ঘুরিয়ে দিতে দেখা যায়। বাস থেকে যাত্রীরাও নেমে পড়েন কোনো উচ্চবাচ্চ ছাড়া।
এ ব্যাপারে মহসিন হক হিমেল নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বহুদিন পর মনে হলো একটা অসাধারণ দৃশ্য দেখলাম। সকাল বেলায় মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। এত এত হতাশার মধ্যে কেউ একজন আছে জানতে চাওয়ার, আমি নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারব কি না! প্রচুর অযোগ্য মানুষের হাতে স্টিয়ারিং চলে যাওয়া এই দেশ এখনো পথ হারায়নি বোধ হয়। আজ সকালে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ে রাস্তায় বাস দাঁড় করিয়েছে আশপাশের স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এই দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার একটা আনন্দ আছে। যে কাজটা পুলিশের করার কথা, যে কাজটা ক্ষমতাবানদের করার কথা, যে কাজটার জন্য দিব্যি একটা প্রতিষ্ঠানই রয়েছে, সেই কাজটা শুরু করেছে ছাত্ররা।’
রেডিসন হোটেলের সামনে ইসমাইল নামে এক প্রতিবন্ধী বলেন, ‘বাস নাই সিএনজি নাই। মহাখালী থেকে হাইট্টা রেডিসন আইছি, যামু উত্তরায়। অনেক কষ্ট হইতাছে। পোলাপাইন আন্দোলন করতাছে। আন্দোলনেও যদি একটা বিহিত হয়! অমানুষগো বিচার হওয়া দরকার।’
আবার কোথাও পায়ে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে এমন মানুষকে সহযোগিতা করে রাস্তা পারাপারে এগিয়ে আসতেও দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। অ্যাম্বুলেন্স, হজযাত্রী, অসুস্থ, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের চলাচলে বাধা দেয়নি শিক্ষার্থীরা। তবে গণপরিবহন চলাচলে বাধার কারণে, কোথাও ছিল যেমন পরিবহন সংকট আবার কোথাও ছিল তীব্র যানজট। যে কারণে হাজার হাজার পথচারী ও গণপরিবহনের যাত্রীকে পড়তে হয় বিপাকে।
উল্লেখ্য, বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর নামে একটি পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে রেডিসন ব্লু হোটেলে বিপরীতে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম ও বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আব্দুল করিম রাজিব মারা যায়।
দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় রোববার দুপুর থেকেই উত্তাল ঢাকা শহর। সোমবার ঢাকার বিভিন্ন সড়ক অবরোধের পর মঙ্গলবারও রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক নিজেদের দখলে নেয় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর ধীরে ধীরে স্থবির ঢাকায় স্বস্তি ফেরে।