বাঁশখালী: চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়ন। মূল সড়ক থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে পিচঢালা রাস্তা গেছে রুদ্রপাড়া গ্রামে। ৭০-৭৫টি পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা গ্রামটিতে কারো বাড়ি পাকা হয়েছে, আবার কারো এখনো মাটির ঘর। গ্রামের বাসিন্দাদের একসময় মূল পেশা ছিল মাটির তৈজসপত্র বানানো। এখন অনেকেই ছেড়েছেন সেসব কাজ। সন্তানদের করেছেন শিক্ষিত। যারা টিকে আছেন পুরনো পেশায়, তাদের ঘরে উঁকি দিচ্ছে দারিদ্রতা।
পাড়ার অনেক বাড়ির সামনে খোলা জায়গায়, দরজার পাশে রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে সারি সারি মাটির তৈরি সামগ্রী। কথা হয় সত্তরোর্ধ্ব বাসন্তী বালা রুদ্র’র সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাকে সাহায্য করছে ছেলের বউ। দুই ছেলের একজন জড়িত এই পেশায়। শহর ও গ্রামের দোকানে মাটির সামগ্রী সরবরাহ করেই চলে আমাদের সংসার।
দেখা গেছে, ৩০ বছরের এক নারী শিশুকে সঙ্গে নিয়ে মাটির তৈরি বড় উনুন থেকে পোড়া খড় সরিয়ে একে একে নামাচ্ছেন নানা রকমের মাটির তৈরি গৃহস্থালী সামগ্রী। আগুনে পুড়ে লাল হওয়া মাটির হাঁড়িগুলোর সঙ্গে দিন বদলের হাওয়ায় এ মৃৎশিল্পীদের ভাগ্যটাও যেন পুড়ে গেছে।
গ্রামের বাসিন্দা মনু রুদ্রের বয়স ৬০ বছর পেরিয়েছে। বংশ পরম্পরায় এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন। আজো চাক ঘুরিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন। হস্তচালিত কাঠের ঘূর্ণায়মান চাকায় সযত্নে দুই হাতের তালু আর আঙ্গুলের কোমল ছোঁয়ায় নরম কাদামাটি দিয়ে তৈরি করে যাচ্ছেন জগ, কলসি, পিঠা-পুলির সামগ্রী। মাটি দিয়ে জাদুকরী সৃষ্টি মিশে আছে এ গোলাকার হাঁড়ির মুখে। চাকা থেকে নামিয়ে তৈজসপত্র রোদে শুকানো হচ্ছে উঠোনজুড়ে।
পাশে নিজের বাড়ির সামনে তার স্ত্রী ছোট কাঠের টুকরোর সাহায্যে পরম মায়ায় তৈরি করছেন ভাপা পিঠার বাটি। কাঠের বেলনার প্রতিটি হালকা আঘাতে ফুটে উঠছে আগুনে পোড়া জীবন সংগ্রামের কাহিনি।
সাধনপুর গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে কালীপুর গ্রামের রুদ্রপাড়ার চিত্রও প্রায় একই ধরনের। গ্রামের খোকন রুদ্র জানালেন তাদের দুখের কথা। সারাদিন পরিশ্রম করে একশ হাঁড়ির মুখ তৈরি করে পান মাত্র ১০০ টাকা। প্রতিদিন হাঁড়ি তৈরি করা যায় ৪০-৫০টি। নিজের চাকায় তিনশ হাঁড়ি বানাতে মাটি কেনা ও পোড়ানো বাবদ খরচ হয় ১২০০-১৫০০ টাকা। সবমিলিয়ে একেকটি হাঁড়ি তৈরিতে নিজের পারিশ্রমিক ছাড়াই খরচ হয় ১০-১২ টাকা। বাজারে ও ব্যাপারিদের কাছে বিক্রি করতে হয় ১৫-১৭ টাকায়। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে দিয়েছেন, যাতে তাদের এ পেশায় আসতে না হয়। বাবা-মায়ের কাছ থেকে কাজ শিখে নিজেই প্রায় পঁচিশ বছর ধরে এ পেশায় আছেন অনিমা রুদ্র। তিনি বলেন, একসময় গ্রাম-গঞ্জে মাটির তৈরি পণ্যসামগ্রীর কদর ছিলো। এসব পণ্য শোভা পেতো প্রত্যেক বাড়িতে। গ্রীষ্মকালে মাটির কলসির এক গ্লাস পানি দূর করে দিতো সব ক্লান্তি। গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পুতুল, খেলনা, প্রতিমা, প্রতিকৃতি, সরা, ফুলের টপ আজও ক্রেতাদের চাহিদা মেটাচ্ছে। অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল আর প্লাস্টিক পণ্যের কারণে মাটির সামগ্রীর বাজার এখন মন্দা।