বিয়ের উৎসব
টিকলি ঠিক করতে গিয়ে মাথার ওড়না নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেঁজুতির। পাশে বসে গোপাল ভেবেই পাচ্ছেন না—পাগড়ি কীভাবে লাগাবেন। নতুন বউয়ের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে গোপালের হাত থেকে মুঠোফোনটাই গেল পড়ে। যাই হোক, অবশেষে দোলনায় বসে সেলফি তোলা শেষ হলো। টিকলি, নোলক, লাল টুকটুকে ওড়না, পাগড়ি খুলে জমা দিয়ে দিলেন তাঁরা।
জানা গেল, সেঁজুতি ও গোপাল বাস্তব জীবনে বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দুই বাড়ির কেউ এখনো কিছু জানেন না। তবে শিগগিরই তাঁরা তা জানাবেন। দুজনই চিকিৎসক হয়েছেন। বিয়ে নিয়ে উৎসাহ থেকেই দুজন এসেছেন রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়ুশ-নকশা বিয়ে উৎসবে।
অ্যাথেনাস ফার্নিচারে এ সেলফি তোলার অফার ছিল। ফেসবুকে এ প্রতিষ্ঠানের পেজে সেলফি পোস্ট করার পর যে ছবি বেশি লাইক পাবে, তাঁদের জন্য থাকবে বিশেষ উপহার। সেঁজুতি এক ফাঁকে রূপসজ্জা প্রতিষ্ঠান পারসোনায় গিয়ে বিনা মূল্যে হাতে মেহেদিও লাগিয়ে নিলেন। বিনা মূল্যে মেহেদি দেওয়ারও সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে এ উৎসবে।
বৃহস্পতিবার সকালে হোটেলের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ওয়েসিসে শুরু হওয়া এ উৎসবের আয়োজন করেছে দৈনিক প্রথম আলোর মঙ্গলবারের ক্রোড়পত্র নকশা ও ইউনিলিভারের প্রসাধন ব্র্যান্ড আয়ুশ।
‘বিয়ের বাজার দেশেই’—এ ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করা জন্য পঞ্চমবারের মতো এ আয়োজন হচ্ছে। রঙিন কাপড় দিয়ে উৎসবে ঢোকার গেট সাজানো হয়েছে। সকালেই ফুল দিয়ে সাজানো অনেকটা গাড়ির আদলে তৈরি পালকিতে চড়ে উৎসব প্রাঙ্গণে আসেন উপস্থাপিকা, মডেল ও অভিনেত্রী মাসুমা রহমান নাবিলা ও তাঁর বর জোবায়দুল হক রিম। ১৮ বছর ধরে তাঁদের জানাশোনা। আট মাস আগে বিয়ে করেছেন। উৎসব প্রাঙ্গণে এই দম্পতি আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় নানান আনুষ্ঠানিকতা। ব্যান্ড পার্টির বাদ্যের তালে তালে বিয়ের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী গেটের ফিতা কাটা, শরবত ও মিষ্টি খাওয়ানো, মালাবদল, ফটোশুটে অংশ নেওয়া, র্যাম্পে হাঁটা—সবই করতে হয়। আর নতুন দম্পতিকে বরণ করার আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক ও ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন।
খোলা আকাশের নিচে বানানো মঞ্চ থেকেই এই দম্পতি উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। নাবিলা দৃঢ় গলায় বললেন, নিজের দেশের পণ্যের প্রসার ঘটাতে হবে। আর জোবায়দুল হক রিম বললেন, গত ১০-১৫ বছরে দেশীয় পণ্যের প্রসার ঘটেছে। তবে বিয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দামের দিকটাতে নজর দিতে হবে। কেউ যাতে মনে না করেন, দেশের বাইরে থেকে তো এই দামেই পণ্য কেনা যায়।
এভাবে এ উৎসব ক্রমে জমে ওঠে। এক ফাঁকে উৎসব ঘুরে যান প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়াও বিয়ের আগে ও পরে কত যে পরিকল্পনা করতে হয়, তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন। বর-কনের ছবি তোলা, তাঁদের ঘর সাজানো, হানিমুনে যাওয়ার খরচ—কোনোটাই ফেলনা নয়। যাঁরা নতুন বিয়ে করবেন বা করার পরিকল্পনা করছেন বা বিয়ে নিয়ে আগ্রহ আছে, তাঁদের জন্য বিয়ে উৎসবে বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন ও স্টলে পণ্য সাজিয়ে বসেছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আর উৎসব উপলক্ষে ছিল বিভিন্ন পণ্যে ছাড়ের ছড়াছড়ি। রূপসজ্জাসহ যেকোনো বিষয়ে পরামর্শের জন্যও ছিলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরামর্শকেরা।
বিয়েবাড়িতে হাজারো ঝামেলা থাকে। বিয়ে উৎসবই বা তা থেকে ব্যতিক্রম হবে কেন! তাই খোলা মঞ্চে বসে নাবিলা-রিম দম্পতি যখন নিজেদের বিয়ের অভিজ্ঞতা বলছিলেন, তখন সাজানো মঞ্চ একটু হেলে পড়ল এ দম্পতির গায়ে। তবে আধুনিক চটপটে দম্পতি বলে কথা, ঠিকই তাঁরা তা সামলে নিলেন।
নতুন দম্পতি খোলা মঞ্চ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মঞ্চে চলতে থাকে দন্ত্যস রওশনের বিয়ে নিয়ে অণুকাব্য, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছোট সায়েমের গান বা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা থেকে আসা বাউলদের গান। আজ বিয়ে উৎসবের মঞ্চে গান গাওয়াই ছিল সায়েমের জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো মঞ্চে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা।
সায়েম যখন একটার পর একটা গান গাইছিল, তখন মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে পায়ে তাল দিতে দিতে হোটেল সোনারগাঁওয়ের একজন কর্মী শহীদ তা শুনছিলেন। জানালেন, কাজ একটু কম থাকায় উৎসবে এসেছিলেন। বললেন, সায়েম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও তার মধ্যে অনেক প্রতিভা আছে, একটু ভালো পরিবেশ পেলে ছেলেটা জীবনে অনেক উন্নতি করবে।
রাজধানীর আগারগাঁও তালতলা থেকে এসেছেন কুমুদিনী হাজরা। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে লাবণী বিশ্বাস মায়ের সঙ্গে এসেছে লাল টুকটুকে শাড়ি পরে। মা ও মেয়ে হাসিমুখে ফুল দিয়ে সাজানো পালকিতে ছবি তুললেন। কুমুদিনী হাজরার আরেক মেয়ে এইচএসসি পাস করেছে। মেয়েরা বড় হচ্ছে, তাই মেয়েদের বিয়ে নিয়ে নানান চিন্তা তো থাকেই। উৎসবে এসে বিভিন্ন তথ্য জানতে পেরেছেন বলে জানালেন এই মা। আর মা ও মেয়ে একসঙ্গে ছবি তোলার অনুভূতি জানাতে গিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘অসাধারণ!’
সবুজ টিয়ে রঙের একই রকমের পোশাক গায়ে দিয়ে উৎসবের প্রায় সব কটি স্টল ঘুরে দেখেন ইতি ও খিলখিল। তাঁরা দুজনই একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করেন। দুই বোন এখনো বিয়ে করেননি। তবে বিয়ে যে করবেন না তা তো নয়। তাই তাঁদের উৎসব নিয়ে এত আগ্রহ।
বিয়ে নিয়ে মহাপরিকল্পনা ছাড়াও কেউ কেউ উৎসবে ঢুঁ দেন। সুফী ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল গোফরান উৎসবে এসেছিলেন কাতার থেকে বাংলাদেশে আসা দুই অতিথিকে নিয়ে।
টাকায় আহার, এক টাকায় চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম করে আলোচনায় আসা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্টলেও অনেকে ঢুঁ দিচ্ছেন। এ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক রওশন আক্তার বলেন, ‘পথশিশুদের কাছে বিয়ের খাবারের আলাদা আকর্ষণ থাকে। তারা অপেক্ষায় থাকে কখন বেশি হওয়া খাবার ফেলে দেবে আর তারা তা খাবে। তবে এখন বিয়েতে অনেকেই পথশিশুদের দাওয়াত দেন। যাঁরা পথশিশুদের খাওয়াতে চান, তাঁরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা পথশিশুদের গোসল করিয়ে, জামা কাপড় পরিয়ে নিয়ে যাই। এ ছাড়া কেউ যদি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার পর বাড়তি খাবার পথশিশুদের দিতে চান, আমরা নিয়ে এসে বিতরণ করি। তবে এ খাবার আমরা বিনা মূল্যে নিই না, এক হাজার টাকার বই উপহার দিই নতুন দম্পতিকে।’
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কক্সটুডে, সাদিয়া বেনারসি হাউস, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির, মেকআপ–বিষয়ক অ্যাসোসিয়েশন মেবাব, প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, অ্যাথেনাস ফার্নিচার, ওরিয়ন টি কোম্পানি, ওরিয়ন ফুটওয়্যার, এম আর রানা ফটোগ্রাফি, বানিস ক্রিয়েশন, পারটেক্স ফার্নিচার, লুবনান রিচম্যান ইনফিনিটি, রস, লাভেলোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল ও প্যাভিলিয়নে উৎসুক দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকে। আর উৎসবে আসা মানুষজন, বিশেষ করে মেয়েরা সেজে এসেছেন অনেকটা বউয়ের সাজে। আর উৎসবে এসে ছবি তুলবে না, তা তো হতে পারে না, তাই হয় সেলফির ক্লিক, নয়তো একজন আরেকজনের ছবি তুলে দেওয়া বা দল ধরে ছবি তোলার হিড়িক লেগেছে উৎসবে।
উৎসব আজ চলবে রাত আটটা পর্যন্ত। কাল শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এ উৎসব চলবে। দুই দিনব্যাপী উৎসবটি সবার জন্য উন্মুক্ত।
উৎসবটি সরাসরি সম্প্রচার করছে নাগরিক টেলিভিশন।