ধুঁকে ধুঁকে কোনমতে টিকে আছে ৫২ বাড়ির একটি বিস্ময়কর শহর। চেনাজানা হলে হলিউড বা বলিউডের ব্যয়বহুল সিনেমা’র শ্যুটিং হতো এখানে। এ নগরী পর্দায় দেখে অবাক হতেন বিশ্বের লাখো কোটি দর্শক। তবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুব পরিচিত না হলেও প্রতিবছর এই লুকিয়ে থাকা নগরীই ঘুরে ফিরে দেখতে আসছেন হাজার হাজার বিদেশী পর্যটক। শত শত নাটক, সিনেমা আর মিউজিক ভিডিওর শুটিং হচ্ছে এখানে। হ্যা বলছি, নারায়নগঞ্জ সোনারগাঁওয়ের ‘পানাম সিটি’র কথা।
প্রায় তিন শ’ বছর আগে শীতল্যা নদী তীরের অভিজাত এ শহর গড়েছিলেন, ঈশা খাঁর শাসনামলের বনেদি ব্যবসায়ীরা। এক সময় আয়তন ছিলো প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার। এখন তার নমুনা টিকে আছে মাত্র ২ বর্গ কিলোমটার জুড়ে। বাংলার যে মসলিন কাপড় বিশ্বব্যপী পরিচিত প্রসিদ্ধ তা তৈরির মুল কারখানাও ছিলো এই নগরে। আমেরিকান সংস্থা ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ডের জরিপে বিশ্বের ১০০টি বিলুপ্তপ্রায় শহরের একটি বলা হচ্ছে পানাম নগরীকে।
পঞ্চদশ শতকে ঈসা খাঁর শাসনামলে সোনারগাও ছিলো রাজধানী। পরে বনেদি হিন্দু ব্যবসায়ীরা তাদের বানিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়েন পানাম নগরীকে। শহরটিতে পাশ্চাত্য কারুকাজে আভিজাত্যের সাথে নির্মাণ করা হয় একতলা, দোতলা বহু বাড়ি। যার মধ্যে ৫২টি এখনো টিকে আছে। এক রাস্তার দু’পাশে সারি সারি এসব বাড়ি সত্যিই দেখার মতো । বাড়িগুলো নির্মাণে ব্যবহার হয়েছে মোঘল, গ্রীক ও গান্ধারা স্থাপত্যশৈলী। এর জন্য বিদেশ থেকে আনা হয়েছিলো কারিগরদের। ইট-সুড়কির সাথে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই লোহা আর শাল কাঠ। আছে বৃটিশ আমলের সিরামিকের টাইলস। লাল, সাদাকালো আর রঙিন মোজাইক কারুকাজ। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গার সময় হিন্দু ব্যবসায়ীদের বনেদি এই পানাম নগরী লুটেরাদের কবলে পড়ে। সম্পদের সাথে তখন লুট হয়ে যায় বাড়িঘরের দরোজা, জানালা, ঝাড়বাতি আর কাজকাজ।
যুদ্ধের সময় হিন্দু ব্যবসায়ীরা ভারতে চলে গেলে পানাম নগরী জনমানবহীন হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে ধংস হতে থাকে সমৃদ্ধ পানাম নগরী। দেশ স্বাধীন হবার পর পানাম নগরীর বাড়িগুলো স্থানীয়দের কাছে ১০/১৫ বছরের চুক্তিকে লিজ দেয়া হয়। পরে তা নবায়নও হয়। কিন্ত ২০০৪ সালের পর আর কাউকে আর থাকতে দেয়া হয়নি ওইসব বাড়িতে। তাই পানাম এখন ভুতুরে নগরী। ২০০৫ সালে পানাম নগরীর ঐতিহ্যবাহি দুইটি বাড়ি পুরোপুরি ধ্বসে পড়ে। অযতœ আর অবহলোয় বেশিরভাগ বাড়ি এখন জরাজীর্ন। শেওলা ধরেছে, ভেতরের পরিবেশও হয়ে পড়েছে স্যাতস্যাতে, ভৌতিক আর অন্ধকার। অনেক বাড়ির সিরামিক টাইলসে ভাঙ্গন ধরেছে। খসে পড়ছে পলেস্তরা। কোথাও কোথাও ছাঁদও ধ্বসে পড়ছে। পানাম নগরের সুরা আর পানি সরবরাহের জন্য তখন দুইপাশে করা হয়েছিলো দুইটি খাল আর ৫টি পুকুর। এখন তাও হারিয়ে গেছে।
তবে সম্প্রতিকালে এই ঐতিহাসিক নগরীটি রায় সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বতর্মানে টিকেট কেটে পানাম নগরীতে দর্শনার্র্থীদের প্রবেশের ব্যবস্থা করেছে, উপজেলা প্রশাসন। নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছে আনসার। তবে পর্যাপ্ত সুবিধা, প্রচারণার অভাবে বিখ্যাত এই নগরী দেখতেও মানুষের ভিড় খুব একটা হচ্ছে না। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দুরেই এই শহর। গাড়িতে লাগবে এক ঘন্টারও কম। চলে আসুন পানাম নগরীতে, দেখে নিন বাংলার ঐতিহ্য সম্ভার। গর্ব করে বলুন সারাবিশ্বে এই বাংলা আমার।