ওষুধ বিপ্লব দেশ ছাপিয়ে বিদেশে
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ওষুধ তৈরিতে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছে। বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশের ওষুধ। শুধু মানুষের ওষুধই নয়, একাধারে দেশে তৈরি হচ্ছে প্রাণিসম্পদ ও কৃষিভিত্তিক উৎপাদনশীল খাতের ওষুধও, যাকে গত ৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম বড় অর্জন হিসেবেই দেখছেন ওষুধ খাতের মানুষ। বিশ্বের এমন কোনো ওষুধ নেই, যা বাংলাদেশে তৈরি করা সম্ভব নয়
পোশাক তৈরির পরপরই এখন সবচেয়ে বড় শিল্প খাত হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ওষুধ তৈরিতে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছে। বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশের ওষুধ। শুধু মানুষের ওষুধই নয়, একাধারে দেশে তৈরি হচ্ছে প্রাণিসম্পদ ও কৃষিভিত্তিক উৎপাদনশীল খাতের ওষুধও, যাকে গত ৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম বড় অর্জন হিসেবেই দেখছেন ওষুধ খাতের মানুষ। বিশ্বের এমন কোনো ওষুধ নেই, যা বাংলাদেশে তৈরি করা সম্ভব নয়। এমনকি চলতি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির জন্যও প্রস্তুত বাংলাদেশ। অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত অনেক ওষুধের দাম বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বহুগুণ কম হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশগুলো থেকেও অনেকে শুধু ওষুধ কেনার জন্য ছুটে আসছেন বাংলাদেশে।
ওষুধ অধিদপ্তরের সব শেষ তথ্য অনুসারে বিদেশ থেকে প্রযুক্তি ও উপাদান এনে এখানে তৈরি বা বাজারজাতকৃত সরকার অনুমোদিত জেনেরিক ওষুধের (অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক) সংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে তিন হাজার। প্রায় ৩০ হাজার ব্র্যান্ড নাম ব্যবহার করে এসব ওষুধ প্রস্তুত করছে প্রায় আড়াই শ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে শুধু অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানেই ব্র্যান্ড ওষুধের সংখ্যা ২৮ হাজার ৫০০। ১০০টির বেশি দেশে এখন যায় বাংলাদেশের ওষুধ। দেশের মানুষের ওষুধের চাহিদার প্রায় ৯৭ শতাংশ পূরণ হচ্ছে দেশে উৎপাদিত ওষুধের মাধ্যমে। ওষুধ খাতে এখন বার্ষিক সঞ্চালন ঘটে প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অন্যদিকে কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, দেশে এখন অনুমোদিত কৃষি কীটনাশক-বালাইনাশকের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এসব ওষুধের জন্য আমদানিকারী প্রতিষ্ঠান সাড়ে ৩০০, রিপ্যাকিং প্রতিষ্ঠান দেড় শ আর ফরমুলেশনের অনুমোদনধারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৫টি।
সাধারণ মাথা ব্যথা থেকে শুরু করে দুরারোগ্য ক্যান্সারের ওষুধ এবং টিকা পর্যন্ত সব কিছুই এখন তৈরি হয় দেশে। দেশে ওষুধ খাতে এখনো অর্থ সঞ্চালন দুই বিলিয়নের বেশি। বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ওষুধ উৎপাদন যন্ত্রপাতি আছে দেশে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে ওষুধ উৎপাদনে পথচলা শুরু হয়। আর সেই ৫০ বছরে সফল এক খাতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প। তবে এই ৫০ বছরের মধ্যে গত ৪০ বছরে ওষুধ খাতে যেন রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। একের পর এক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সবচেয়ে বেশি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের যেখানেই নতুন কোনো ওষুধ উদ্ভাবিত হয়, সেটিই উৎপাদনে সক্ষম হয়ে ওঠে বাংলাদেশ, যদিও এখন পর্যন্ত দেশে কোনো জেনেরিক ওষুধ আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করা হয়ে ওঠেনি কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে। গবেষণার জায়গায় কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না ঘাটতি। তবু বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন ওষুধ ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর হিসেবে ঈর্ষণীয় মর্যাদায় অবস্থান করছে।
মানুষের ওষুধের পাশাপাশি গবাদি পশু কিংবা প্রাণিসম্পদের ওষুধ উৎপাদন সমানতালে এগিয়ে চলছে দেশ। কৃষি খাতের ওষুধের ক্ষেত্রেও কমতি নেই। কিছু ক্ষেত্রে মান কিংবা আসল-নকল-ভেজালের প্রশ্ন থাকে বরাবরই। ওষুধ বিপণন ব্যবস্থায় আধুনিকতা ও কাঠামোগত নানা পরিবর্তন এসেছে। ওষুধের মোড়ক দিন দিন দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় হচ্ছে। সরাসরি ক্রেতারা যেমন দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যখন-তখন ওষুধ নিজেরা গিয়ে কিনতে পারছে, তেমনি গত কয়েক বছরে অনলাইনে ওষুধ কেনাকাটার ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে শক্ত ভিত্তির ওপর। ফার্মেসি মিলে যায় দেশের যেকোনো দুর্গম চরাঞ্চলেও। ওষুধ বিক্রেতা কিংবা ফার্মাসিস্টদের সংখ্যাগত সংকট কিংবা নিবন্ধনকৃত ফার্মেসি নিয়ে নিয়ম-অনিয়মের প্রশ্ন থাকলেও তা আগের থেকে অনেকটাই কমে এসেছে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্য দিয়ে।
চলতি করোনাভাইরাসের মহামারির সময়েও বাংলাদেশে করোনা চিকিৎসায় চলে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বিশ্বের যেখানেই কোনো ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়েছে, সেই ওষুধই এখানে উৎপাদনে লেগে পড়ে ওষুধ কম্পানিগুলো। করোনার সময়ও এখানে ওষুধ উৎপাদন ও রপ্তানি থেমে থাকেনি। বরং করোনাকালেও ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে ওষুধ। দেশে এখনো সরকারি হাসপাতালে যে রেমডেসিভির ব্যবহৃত হচ্ছে বিনা মূল্যে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য, তা দেশেরই একটি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত হচ্ছে। এ ছাড়া বহুল আলোচিত আইভারমেকটিন কিংবা ডক্সিসাইক্লিনও উৎপাদিত হয় দেশেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম-নীতি মেনেই গড়ে উঠেছে একেকটি ওষুধ কারখানা। এসব কারখানায় দেশি-বিদেশি উচ্চতর ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞরা নিয়োজিত আছেন ওষুধ তৈরি ও মান নিয়ন্ত্রণের কাজে। এর বাইরে ওষুধ বিপণন ব্যবস্থাপনার আওতায় সারা দেশে ছড়িয়ে আছে বিশাল এক তরুণ জনগোষ্ঠী, যাদের মেধা, দক্ষতা ও পরিশ্রমে দেশের মানুষ সহজে-সুলভে হাতের কাছেই প্রয়োজনমতো পেয়ে যাচ্ছে বিশ্বমানের দেশি ওষুধ।