প্রবাসহাইলাইটস

অভিবাসী কর্মীর মৃত্যুহার বেশি বাংলাদেশীদের

kkকভিড-১৯ মহামারীর কারণে গত বছরের শুরু থেকেই নানা ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা অভিবাসী শ্রমিকরা। ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় ছুটিতে এসে অনেকে যেমন আটকা পড়েছিলেন, তেমনি কাজ হারিয়েও ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন অনেকেই। অন্যদিকে যারা বিদেশে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অবস্থানের কারণে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের অনেকেই। এমনকি অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে করোনায় মৃত্যুহার বাংলাদেশীদেরই বেশি।

রামরুর বিশ্লেষণ বলছে, অভিবাসনের গন্তব্য দেশগুলোয় অবস্থানরত প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে বাংলাদেশীদের মৃত্যুর হারই বেশি। ‘বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসনের গতি-প্রকৃতি ২০২০’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যেকোনো মহামারী পরিস্থিতিতে অভিবাসীরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকেন। ১৯৩০-এর বিশ্বমন্দা, ১৯৭৩-এর জ্বালানি তেল সংকট, ১৯৯৭ ও ১৯৯৯ সালের এশীয় অর্থনৈতিক সংকট বা ২০০৯-১০ সালের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় অভিবাসীরাই সবচেয়ে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। ২০২০ সালের কভিড-১৯ সংকটেও সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখে ছিলেন অভিবাসী শ্রমিকরা। অভিবাসনের গন্তব্য দেশগুলো অন্যান্য দেশ থেকে আগতদের তুলনায় বাংলাদেশীদের মৃত্যুও অনেক বেশি দেখা গিয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৬টি দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের মধ্যে ৭০ হাজার জন কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৩৮০ জন অভিবাসী। গত ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশে ২ হাজার ৩৩০ জনের বেশি বাংলাদেশী কর্মী করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবেই মৃত্যু হয়েছে ৯৮৯ অভিবাসীর। সংযুক্ত আরব আমিরাতেও বাংলাদেশী কর্মীদের মৃত্যুর হার বেশি। গত জুলাই পর্যন্ত দেশটিতে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৩২৮ জনের। তাদের মাঝে ১২২ জনই বাংলাদেশী নাগরিক। এছাড়া কুয়েতে কভিড-১৯-এর কারণে মৃতের সংখ্যা ৩৮২। তাদের মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা ৬০।

বিশ্বে অভিবাসী কর্মীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার দিক থেকে প্রথম সারিতে বাংলাদেশীরা। গত ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে করোনায় আক্রান্ত অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার, যা দেশটিতে বসবাসরত মোট অভিবাসী শ্রমিকের ৪৭ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশী কর্মী আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২৩ হাজার। সে হিসেবে সিঙ্গাপুরে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত অভিবাসী শ্রমিকের ৪০ শতাংশই বাংলাদেশী।

তবে চিকিৎসাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা যথাসময়ে নেয়ায় দেশটিতে মাত্র দুজন বাংলাদেশীর মৃত্যুর তথ্য পেয়েছে রামরু। এছাড়া মালদ্বীপে পর্যটন খাতে প্রচুর বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের অধিকাংশই অনিয়মিত। দেশটিতে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশী কর্মী আক্রান্ত হলেও কোনো মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা  বলেন, বাংলাদেশী অভিবাসীদের প্রধান গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান ও বাহরাইন। এর বাইরে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় প্রচুর বাংলাদেশী কর্মী রয়েছেন। এসব দেশে একসঙ্গে অনেক কর্মী গাদাগাদি করে ডরমিটরিতে অবস্থান করতে বাধ্য হন। এ কারণে স্বাস্থ্যবিধি সেভাবে মানতে না পারায় তাদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি। অন্যদিকে অতিরিক্ত পরিশ্রম ও পুষ্টিকর খাবারের অভাবে কর্মীরা নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। মৃত্যুবরণ করা কর্মীদের অধিকাংশই হূদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনির রোগসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।

রামরুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার অনুযায়ী দুর্যোগকালে অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব শ্রমগ্রহণকারী দেশের। সৌদি আরব, কুয়েত ও কাতার অভিবাসী শ্রমিকদের বিনা মূল্যে কভিড-১৯ পরীক্ষার সুযোগ দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। তারা নিয়মিত ও অনিয়মিত অভিবাসীর মধ্যে এদিক থেকে কোনো তফাত করা হবে না বলেও নিশ্চিত করেছিল। তবে রামরুর সমীক্ষা অনুযায়ী, করোনাকালে শুধু যাদের জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে ৪৬ শতাংশের পরীক্ষা করানো হয়েছে। বাকিরা পরীক্ষা করানো ছাড়াই প্রত্যাবর্তন করেছেন। ধরা পড়ার ভয় থাকায় অনেক অনিয়মিত অভিবাসী কর্মী করোনার লক্ষণ দেখা দিলেও পরীক্ষা করাতে যাননি।

প্রসঙ্গত, কভিড-১৯ সংক্রমণ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে কাজ হারিয়ে বিপুলসংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য বলছে, গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরব, ইউএই, কুয়েত, কাতারসহ ২৮টি বৈদেশিক শ্রমবাজার থেকে ফিরে এসেছেন ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন প্রবাসী। তাদের মধ্যে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৮৪ জন পুরুষ ও ৩৯ হাজার ২৭৪ জন নারী।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button