মামুন ও নাসিমুলের মাস্টার র্যাকের গল্প
কারখানার কাজে আপাতদৃষ্টি কম গুরুত্বপূর্ণ, অথচ ভীষণ প্রয়োজনীয় বস্তু হচ্ছে র্যাক বা তাক। কাঁচামাল থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্য গুছিয়ে রাখাসহ সব জায়গাতেই প্রয়োজনীয় পণ্য হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল র্যাক। খুব সহজে স্থাপনযোগ্য এসব লোহার র্যাক আগে আসত বিদেশ থেকে। তিন বছর ধরে ব্যবসায়ী আল মামুন ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নাসিমুল হক দেশেই তৈরি করছেন বিশ্বমানের র্যাক। তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম মাস্টার র্যাক। মামুন ও নাসিমুলের ভাষায়, এখনো ঠিক করে ধরাই হয়নি ব্যবসাটা, তাতেই তাঁদের বার্ষিক আয় পৌঁছেছে প্রায় ৪০ কোটিতে।
র্যাক ব্যবসার সবচেয়ে শক্তির জায়গা হচ্ছে দিন দিন কমে আসছে পণ্য রাখার জায়গা। আবার বাড়ছে জায়গার দামও। প্রতিষ্ঠানগুলো চেষ্টা করে লম্বালম্বি তাক তৈরি করে অল্প জায়গায় অনেক পণ্য রাখতে। এভাবেই দেশে দেশে দিন দিন বাড়ছে র্যাকের চাহিদা ও ব্যবসা। সাধারণ তো বটেই, সফটওয়্যার দিয়ে অটোমেশন করে চালাতে হয় এতই বড় র্যাকের আকার এবং কাজ।
মাস্টার র্যাকের মাস্টারমাইন্ড মূলত আল মামুন। ৫০ বছর ছুঁই ছুঁই মাথার মামুন চুল দেখিয়ে বললেন, অনেক চুল পাকিয়ে পরে র্যাক তৈরি ব্যবসায় আসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে মাস্টার্স আল মামুন তরুণ বয়সে বাবার ফ্যানের ব্যবসায় হাল ধরেছিলেন। কিন্তু পালে লাগে অন্য হাওয়া। কীভাবে তা টেনে নিয়ে যায় মামুনের ভাগ্য, শোনা যাক তাঁর মুখেই।
‘বাংলাদেশে তখন এক্সস্ট ফ্যান আমদানি হচ্ছিল, ইতিমধ্যে আমরা ফ্যান তৈরির ব্যবসা হারিয়েছি, আমদানি করে কোনোক্রমে টিকে ছিলাম। আমাদের মূল ক্রেতা পোশাক কারখানাগুলো। তখন আমাদের একজন ক্রেতা অনন্ত গ্রুপের উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মো. শাহবুদ্দিন আমাকে পরামর্শ দেন র্যাকের ব্যবসাটা ধরতে। তিনিই হাতে–কলমে শেখান বিষয়টি। আমি চীন ও মালয়েশিয়া থেকে র্যাক আমদানি করে ব্যবসা শুরু করি তখন। মালয়েশিয়ার আমদানি করা র্যাকের ক্ষেত্রে মজার বিষয় ছিল তাদের কোম্পানির কর্মী। তাঁদের সবাই বাংলাদেশি। এই বিষয়ই আমাকে আগ্রহী করে বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের।’
ঢাকায় যখন আল মামুনের পালে র্যাক কারখানার হাওয়া, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নাসিমুল তখন তাঁর সমুদ্রযাত্রার জীবন গুটিয়ে আনছেন। এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয় মৃদুভাষী নাসিমুল আর কথার রাজা মামুনের।
নাসিমুল বললেন, ‘আমিও ভাবছিলাম, ডাঙায় ফিরে কিছু করব। আমার শক্তির জায়গা ইঞ্জিনিয়ারিং, আমি জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কাজ করেছি দীর্ঘদিন। মোটামুটি লোকজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু আমি পানিতে থাকা মানুষ, ডাঙার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভারি দ্বিধা। বন্ধুদের আড্ডায় দেখতাম, মামুন খুব কথায় পটু। যখন মামুন আমাকে যৌথ ব্যবসার প্রস্তাব দেয় আমি লুফে নিই।’
নাসিমুল আসারও আগে মামুনের পরিকল্পনা ছিল মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানির হয়ে দেশে কারখানা স্থাপন করবেন। কিন্তু তারা সবকিছুরই অস্বাভাবিক দাম ধরা শুরু করে। অগত্যা মামুন এগোলেন নিজের পথে।
আল মামুনের কথায়, ‘নাসিমুলকে নেওয়ার আগে ভাবলাম, জাহাজে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা কাজের বিষয়ে খুব পটু হন। কারণ, দীর্ঘদিন দূরদূরান্ত পর্যন্ত কোনো সহায়তা তাঁরা পান না। যেহেতু নতুন ব্যবসায় নামা, এক অর্থে পানিতেই নামা, আমি এমন একজনকে বেছে নিলাম, যিনি এই কাজে পটু।’
২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে কাঁচপুরে ৫৫ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে তৈরি হয় মাস্টার র্যাক। মামুন খুঁজে বের করেন এমন শ্রমিকদের, যাঁরা আগে কাজ করেছেন মালয়েশিয়ার কারখানায়। ডেকে এনে চাকরি দেন তাঁর কারখানায়। ছয় কোটি টাকার পুঁজি নিয়ে নেমে পড়েন ব্যবসায়।
তাকের যে কত সূক্ষ্ম কাজ হতে পারে, তা জানা যায় মাস্টার র্যাকের কাঁচপুরের কারখানায় গেলে। পাতলা একটা পাতের কুণ্ডলী আসে বিদেশ থেকে। সেটাকেই মেশিনে আকার দিয়ে তৈরি হয় র্যাক, একদম ক্রেতার চাহিদামাফিক। প্রকৌশলী নাসিমুল বলেন, এখানে একটা নাটবল্টুও প্রকৌশল হিসাবের বাইরে নয়। ক্রেতা শুধু আমাদের বলেন তাঁদের কী পণ্য র্যাকে উঠবে, আর তাঁদের কতটা জায়গা আছে। আমরা হিসাব করে ওজন নেওয়ার ক্ষমতা থেকে শুরু করে স্থানের সর্বোত্তম ব্যবহার, সব নির্ধারণ করে পণ্য তৈরি করি।
এভাবে তৈরি মাস্টার র্যাকের পণ্য কিনতে ক্রেতার খরচ পড়ে আমদানি করা থেকে ১০ থেকে ১২ শতাংশ কম। তবে শুধু এটাই তাঁদের শক্তির জায়গা নয়। যেহেতু মাস্টার র্যাক দেশি প্রতিষ্ঠান, এর বিক্রয়োত্তর সেবাও দিতে পারেন তাঁরা।
মাস্টার র্যাক এখন পর্যন্ত কাজ করেছে জিএমস গ্রুপ, হা-মীম গ্রুপ, স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ, একমি ফার্মাসিউটিক্যালস, পলমল গ্রুপ, প্যাসিফিক জিনস গ্রুপ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোসহ পাঁচ শ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। বিশ্বব্যাপী ইন্ডাস্ট্রিয়াল র্যাকের বার্ষিক বাজার ৮৭০ কোটি ডলারের। ২০২৫ সাল নাগাদ তা পৌঁছে যাবে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারে। বাংলাদেশে এর চাহিদা দেড় শ কোটি টাকার। দিন দিন এটা বেড়েই যাচ্ছে। সেই বাজারেরই মাস্টার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মামুন ও নাসিমুলের মাস্টার র্যাক।