বাঙ্গালীর ইতিহাস ধর্মীও সম্প্রীতির ইতিহাস
দুই বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির খুব গভীরে প্রোথিত আছে ধর্মীও সম্প্রীতির উদার ইতিহাস । হাজার বছরের ইতিহাসে ছড়ানো আছে এই সম্প্রীতির বহুমাত্রিকতা ।
যুক্তরাষ্ট্রের কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেল্ডন পোলক ( Sheldon Pollock ) বলেন , ” বাংলার নবদ্বীপ বা মিথিলা সংস্কৃত ন্যায়চর্চার কেন্দ্র হয়েছিল সুলতানি আমলে। মোগল যুবরাজ দারাশিকো বেদান্ত পড়েছেন বারাণসীর পণ্ডিতদের কাছে। মুসলমান শাসকরা এ দেশে প্রায় বারোশো বছর রাজত্ব করেছিলেন। ওরা জোর করে ধর্মান্তর করালে এ দেশে এক জনও হিন্দু থাকত না। ওদের উত্সাহ না থাকলে সংস্কৃতও টিকে থাকত না।”
ভারতে মুসলিম শাসনে মসজিদের বিরুদ্ধে মন্দিরের যুদ্ধ হয়নি । হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধ হয়নি । যুদ্ধ ছিলো রাজায় রাজায় ।
মহারাষ্ট্রের মারাঠা সেনাপতি ছত্রপতি শিবাজী রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে না । শিবাজির সেনাবাহিনীতে হাজার হাজার মুসলমান সৈনিক ছিলেন । শিবাজীর প্রায় ১২ জন মুসলিম সেনাপতি ছিলেন । মুসলিম কারারক্ষীর সহায়তায় তিনি মুঘল দুর্গ থেকে পালাতে পেরেছিলেন । দীর্ঘ মোগল সাম্রাজ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ ছিলো ক্ষমতা কেন্দ্রিক । । সে সব কোন সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ না । ১৫৭৬ সালে রাজস্থানের হালদিঘাটিতে ( মাটির রঙ হলুদ তাই এই নাম ) সাহসী রাজপুত মহারানা প্রতাপের সাথে যুদ্ধ হয় মুগল সম্রাট আকবরের , ইতিহাসে যা ” হালদিঘাটি যুদ্ধ” নামে পরিচিত । আকবর এই যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহন করেননি । যুদ্ধ হয় মুঘল সেনাপতি মান সিংহ ও মহারানা প্রতাপের সেনাবাহিনীর মদ্ধে । অন্তত দুইজন মুঘল সম্রাট্রের স্ত্রি ছিলেন হিন্দু পরিবার থেকে আগত ।।রাজা রাজপুত্রদের সাথে রাজপুত নারীদের প্রেম ভালোবাসার অমর কাহিনীর কথা ইতিহাসে লেখা আছে ।
বাঙালি নারী পুরুষ অন্তত দুইজন হিন্দু মহাপুরুষের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন । একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যিনি নারীদের শিক্ষা ও বিধবা বিবাহ প্রথার জন্য সংরাম করেছেন । আর একজন রাজা রামমোহন রায় যিনি সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সংরাম করেছেন । রাজা রামমোহন রায়ের একজন স্ত্রি ছিলেন মুসলমান । তিনি মনে করতেন হিন্দু ছেলেরা তাদের বাবা মাকে দেখবে না । লন্ডনে রাজা রামমোহন রায়ের কবরের পাশে উনার ছেলে বরকত আলীর কবর হয় ।
দুর্গাপূজার সময় মহা-অস্টমী-তীথিতে কুমারী পূজা হয় । ১৮৯৮ সালে স্বামী বিবেকানন্দ তার আইরিশ ভক্ত সিস্টার নিবেদিতা সহ কাশ্মীরে এক মাঝীর কন্যা চার বছরের মুসলিম বালিকাকে কুমারী হিসেবে পূজা করেন । সেই থেকে আমাদের অঞ্চলে কুমারী পূজা হয়ে থাকে । মহা ব্রহ্মাণ্ডের অযুত শক্তি নারীতে বিদ্যমান । দেবীত্ত, মাতৃত্ত , সৃষ্টি্ , পালন , ধ্বংস । ২০১৯ সালে ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে যখন টানাপড়েন , তখন কোলকাতায় দত্ত পরিবার , মোহাম্মদ তাহেরের চার বছরের কন্যা ফাতেমাকে নিয়ে কুমারী পূজা সম্পন্ন করেন ।।
‘যত মত তত পথ’ ধারনার প্রবক্তা ধর্মগুরু শ্রী রামকৃষ্ণ প্রথম জীবনে ইসলাম ধর্ম সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন । ”দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত মা ভবতারিণী মন্দিরের কাছেই যে মসজিদে তিনি নামাজ পড়তেন সেটিই দক্ষিণেশ্বরের ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস রোডের উপর অবস্থিত অধুনা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মোল্লাপাড়ার মসজিদ। দুশো বছরেরও বেশি প্রাচীন এই মসজিদটি। এই অঞ্চলের আগের নাম ছিল মোল্লাপাড়া এবং বহু মুসলমান এখানে বসবাস করতেন। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় এই অঞ্চলের সকল মুসলমানই এখান থেকে চলে যান এবং মসজিদটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে আসে। এই বোর্ডের রিপোর্টে এই মসজিদে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নামাজ পড়া, আযান দেওয়ার তথ্য লিপিবদ্ধ আছে।”
শুধু কি বাংলায় ? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডি সি তে ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসের সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুদের শিক্ষা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতী ।। দেবীর পাদপীঠে অধ্যায়ন রত তিনজন শিশু কিশোর । একজন এশিয়ার , একজন ইউরোপিয়ান , একজন আফ্রিকার । ভারতের দূতাবাসের সামনে আছে মহাত্মা গান্ধী । ব্রিটিশ দূতাবাসের সামনে আছে চার্চিল । আফ্রিকার দূতাবাসের সামনে আছে নেলসন মেন্ডালা । জাতির পিতা সুকর্ণ থাকতে পারতেন ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসের সামনে । কিন্তু পৃথিবীর প্রধান মুসলিম অধ্যুষিত দেশের দুতাবাসের সামনে দেবী সরস্বতী ।। যে দেশ প্রিথিবীর বৃহত্তর মুসলিম অধ্যুষিত দেশ । যেখানে মাত্র তিন শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী । সেদেশেও ইসলাম ধর্মের পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম হিন্দু ।।
সাম্প্রদায়িকতার সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই । সাম্প্রদায়িকতা সবসময় ধর্ম নিরপেক্ষ । রাজনৈতিক অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধই এর মূল উদ্দেশ্য ।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাঙালীর ঐতিহাসিক চেতনার অন্তর্গত । এই সম্প্রীতি বাঙালীর আত্মপরিচয় । গনতন্ত্রের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের নামে যারা এই সম্প্রীতির বিরুদ্ধে ,তাদের অবস্থান ইতিহাস ঐতিহ্য ও হাজার বছরের বাঙ্গালী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ।