দেশ

হামরা জীবন দিমো তাও জমি দিমোনা

আশুরার বিলে বাঁধ নির্মাণ

আশুরার বিলে বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে অনশন
আশুরার বিলে বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে অনশন

বিরামপুর (দিনাজপুর): আবাদি জমি নষ্ট করে আশুরার বিলোত মাছচাষ হোক হামরা এটা চাইনা। বিলের জমিত ধানচাষ করে আমরা গিরামের মানুষ বাঁচি আছি। “হামরা জীবন দিমো তাও জমি দিমোনা”। দিনাজপুরের বিরামপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলার দুই অংশে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী আশুরার বিল। আর এ বিলে ক্রসড্যামের বাঁধ পুনর্নির্মাণ প্রকল্প বন্ধের দাবিতে গত ৩১ অক্টোবর থেকে টানা ৯ দিনের আমরণ অনশন করছেন বিলে ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও বৃদ্ধ। এ দাবির প্রেক্ষিতে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কেউ এখনও অনশনে থাকা গ্রামবাসীদের সাথে যোগাযোগ করেননি বলে অভিযোগ করেন অনশনকারীরা।

রবিবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যানের মাঝখানে ১৯শ হেক্টর আয়তনের আশুরার বিলে ক্রসড্যামের বাঁধের উভয়পাশে প্রায় ২৫টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। ভুক্তভোগী কৃষকরা তাদের হাতে ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে অবস্থান করছেন। বাঁধ নির্মাণ বন্ধের দাবিতে সেখানে অবস্থান করছেন হরিপুর, খাটাংপাড়া, ইসলামপুর বাসটেক, আদর্শপাড়া, তালতলা, খলসেগাড়ি, কায়দারগোনা, লোটোপাড়া ও সালামপাড়ার নারীপুরুষ, আবাল, বৃদ্ধবণিতা। এমন কোলের শিশুকে সাথে নিয়ে প্রচণ্ড রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করছেন সেখানকার পুরো পরিবেশ। অনশনকারীদের মধ্যে ৬ অসুস্থ

নির্বাহ প্রকৌশলী ও বিএডিসি দিনাজপুরের উদ্যোগে বৃহত্তর বগুড়া ও দিনাজপুর জেলা ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৯ সালের ২২ জুন আশুরার বিলে ১৮ লক্ষ ৬৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ক্রসড্যাম নির্মাণ প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন হয়। একই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে পর্যটকদের বিনোদন দিতে বিলের মধ্যে ৯শ মিটার দৈর্ঘ্যের দৃষ্টিনন্দন “শেখ ফজিলাতুন্নেছা কাঠের সেতু” তৈরি করা হয়। তখন থেকে বিলের পাড়ের বসবাসকারীরা কাঠের সেতু নির্মাণ ও ক্রসড্যাম নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছিলেন। সর্বশেষ গত শনিবার বিকেলে নবাবগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্রসড্যামের বাঁধ নির্মাণের জন্য সেখানে এক্সক্যাভেটর মেশিন নিয়ে গেলে গ্রামবাসী বাঁধা দেয়। পরে গ্রামবাসীর তোপের মুখে প্রশাসন সেই মেশিন ফেরত নিয়ে যায়।

বিলের পাড়ে বসবাসকারী কৃষকদের দাবি, বিলের পানি ধরে রাখার জন্য প্রশাসনের উদ্যোগে গতবছর ক্রসড্যাম ও ক্রসড্যামের উভয়পাশে বাঁধ নির্মাণ করায় বর্ষাকালে আমাদের আবাদি জমি পানিতে ডুবে যায়। এতে করে একমাত্র আয়ের উৎস ধান নষ্ট হয়। শুধু তাই নয়, এ বাঁধের কারণে তাদের বাড়িঘরেও বিলের পানি ওঠে। বাঁধ নির্মাণ বন্ধের দাবিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পক্ষ থেকে প্রশাসনের নিকট অনেকবার দাবি জানালেও প্রশাসন সে দাবি আমলে নেয়নি।

কারো হাতে প্ল্যাকার্ডে “জীবন নিলে নিয়ে নিন, আমাদের দাবি মেনে নিন, আশুরার বিলে ধানচাষ করতে দিন”,  “জাতির মা তুই দেখে যা, আশুরার বিলের কৃষকের দুরাবস্থা”, “বনে জাতীয় উদ্যান, বিলে ধান বাঁচবে মানুষের প্রাণ”- এসব রকমারি লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে ভুক্তভোগী কৃষকদের হাতেহাতে।

বাঁধের উপরে অনশনে অংশ নেয়া হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা দেলোয়ারা বেগম (৪৭) বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে আশুরার বিলের পাড়ে বসবাস করছি। বিলের জমিতে ধানচাষ করেই আমাদের সংসার চলে। গতবছর এখানে বাঁধ দেয়ায় আমরা ধানচাষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন আমাদেরকে ধানচাষ করতে না দিলে ছেলেমেয়ে নিয়ে না মরতে হবে। “হামরা জীবন দিমো তাও জমি দিমোনা”।

হরিপুর গ্রামে বসবাসকারী স্কুলকলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরাও ক্রসড্যামের বাঁধ নির্মাণ বন্ধের দাবিতে সেখানে অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে হাসিনা আক্তার মীম (১৬) বলেন, আমি এবছর এসএসসি পাশ করেছি। আমার বাবা চাকরি করেন না। বিলের জমি আবাদ করেই আমাদের অভাবের সংসার চলে। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার পরও অর্থের অভাবে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারিনি। এখন বিলের জমিতে আমাদের জমি আবাদ করতে না দিলে অর্থের অভাবে আমার লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যাবে।
মানববন্ধনে নেতৃত্বদানকারী রেজাউল ইসলাম বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে বলেছেন, বাংলাদেশের কোথাও যেনো এক ইঞ্চি জমি পড়ে না থাকে। আমরা পতিত জমিতে আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করি। সেখানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আবাদি জমি নষ্ট করে বাঁধ নির্মাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা ভুক্তভোগীরা প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত মানিনা, মানবো না।

নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. নাজমুন নাহার বলেন, আশুরার বিলের যে অংশটিতে আশেপাশের গ্রামের কৃষক ধানচাষ করেন তার মধ্যে রয়েছে ৫৮৮ একর সরকারি খাস জমি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অবস্থিত এ বিলে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দৃষ্টিনন্দন কাঠের সেতু ও ক্রসড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে। আগামীতে এটি আরো দৃষ্টিনন্দন করতে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে পর্যটকরা জাতীয় উদ্যান ও বিলের সৌন্দর্য দেখার জন্য আসবেন। আর তখন বিলের পাড়ে বসবাসকারী মানুষরাই এর সুফল ভোগ করবেন। তাদের আয়ের পথ সৃষ্টি হবে।
তবে উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশাসনের উদ্যোগে বাঁধ পূনঃনির্মাণ করা হলে সরকারের কী ধরণের লাভ হবে তা বিলে চলমান সুযোগসুবিধা সংক্রান্ত পরিসংখ্যান শেষ না হলে বলা সম্ভব না।

সম্পাদনা
নূরে আলম সিদ্দিকী নূর

এমন আরো সংবাদ

Back to top button