রোবটিকস প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ
একদল ছেলেমেয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। নিজেদের কাজে ব্যস্ত সবাই। সুজয় মাহমুদ নামের যে ছেলেটি দরজা খুলে দিল, সে-ও এই দলেরই একজন। সুজয় রাজধানীর ম্যানগ্রোভ স্কুলের একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। তার বন্ধুরাও সবাই ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ফার্স্ট গ্লোবাল আয়োজিত আন্তর্জাতিক রোবটিকস প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। ১৭৪টি দেশের এই প্রতিযোগিতায় লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করেছে সুজয়দের দল। এই প্রতিযোগিতা স্কুল–কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করা হয়। গত ৩১ অক্টোবর অনলাইনে প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। বড় এই অর্জনে ছোটদের দলটির কাজের আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে। তাই কুশল বিনিময় শেষে আবার কম্পিউটার পর্দায় মনোযোগ দিল তারা। সুজয় জানাল, পড়াশোনার বাইরে রোবটিকস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিই তাদের প্রিয় অবসর। একেকজন একেক স্কুলের শিক্ষার্থী হলেও রোবটিকসের প্রতি আগ্রহ তাদের এক করেছে।
২০১৭ সাল থেকে ফার্স্ট গ্লোবালের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাটিতে নিয়মিত অংশ নিচ্ছে এই ছেলেমেয়েরা। শুরুতে তেমন ভালো ফল আসেনি। প্রথম বছর হয়েছিল ৮৭তম। ২০১৮ সালে স্থান হয়েছিল ১০০–এরও পরে। ২০১৯ সালে সপ্তম। আর এ বছর বাজিমাত! গত দুই বছরে দ্রুত সাফল্যের রহস্য কী? সুজয় বলল, ‘প্রথম থেকেই আমরা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ভালো পারতাম। তবে যান্ত্রিক দিক থেকে বেশ পিছিয়ে ছিলাম। গত দুই বছর এই অংশে বেশি জোর দিয়েছি। আর অন্যান্য দেশের প্রতিযোগীদের দেখেও নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করেছি।’
দলের সবার প্রোগ্রামিং, অ্যানিমেশন, রোবটিকস শেখার শুরু দ্য টেক একাডেমি নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। বিজয়ী দলটির সদস্যদের কাছাকাছি বয়সের আরও ৬০ জন ছেলেমেয়ের রোবটিকসের হাতেখড়ি হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে। মজার ছলে ভিডিও গেমের মাধ্যমে স্কুলপড়ুয়াদের এসব বিষয় শেখায় দ্য টেক একাডেমি। দ্য টেক একাডেমির অন্যতম প্রশিক্ষক শোয়েব মির্জা জানালেন, প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির কলাকৌশল থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেন তাঁরা। যেমন সেলাই মেশিনের প্রযুক্তি থেকে ধারণা নিয়ে এমন একধরনের রোবট বানিয়েছেন, যার সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কলকারখানায় বিভিন্ন পণ্য স্থানান্তর করা যাবে।
এবারের প্রতিযোগিতায় ছিল পানিতে ভেসে থাকার বিশেষ এক যন্ত্র। যেটি ছোট বাচ্চাদের পানিতে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে। এটি গলায় লকেটের মতো পরতে হয়। লকেটের অংশটি পানির সংস্পর্শে এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফুলে বেলুনের আকার ধারণ করে। ফলে লকেট গলায় থাকলে শিশু ভেসে থাকবে। একই সঙ্গে ওই শিশুর অবস্থান জানিয়ে অভিভাবকের মুঠোফোনে একটি বার্তা পৌঁছে যাবে।
এই উদ্ভাবনই অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ দলের মূল পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। প্রতিযোগিতার ‘টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জ’ ধাপে তারা পেয়েছে সর্বোচ্চ ৩০ পয়েন্ট। অন্য দুই ধাপ—স্যোশাল মিডিয়া চ্যালেঞ্জ ও প্রশ্নোত্তর পর্ব মিলিয়ে সংগ্রহ মোট ১১৭ পয়েন্ট। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারী দেশ চিলি ও আলজেরিয়ার পয়েন্ট যথাক্রমে ১১৫ ও ১১২। স্যোশাল মিডিয়া চ্যালেঞ্জ ধাপে কানেকটিং পিপল শিরোনামে ৩০ সেকেন্ড ব্যাপ্তির একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ও একটি মিউজিক ভিডিও বানিয়েছে বিজয়ী দল। অ্যানিমেশন চিত্রের চরিত্রগুলোর নকশা করেছে দ্বাদশ শ্রেণির বিয়াঙ্কা হাসান ও অষ্টম শ্রেণির জাহরা চৌধুরী। প্রতিযোগিতায় সফটওয়্যার ডিজাইনের দায়িত্বও ছিল তাদের কাঁধে।
এ ছাড়া করোনাভাইরাসের কথা মাথায় রেখে কোভিট্রন-১ নামে একটি রোবট বানিয়েছে তারা। ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত এই রোবটের সাহায্যে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে একজন মানুষের কাছে নিরাপদে খাবার, ওষুধসহ ছোটখাটো জিনিস পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক এই রোবটিকস প্রতিযোগিতায় প্রতিবছরই শতাধিক দেশ অংশ নেয়। মূলত অলিম্পিকের আদলে প্রতিযোগিতাটি আয়োজিত হয়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী দেশগুলো তাদের একটি করে প্রতিনিধিদল পাঠায়। তাই প্রতিযোগিতাটি হাইস্কুল পর্যায়ের রোবটিকস অলিম্পিক হিসেবেই পরিচিত।