ব্যবসাসফল মামুনের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন
প্রত্যেক ব্যবসাসফল উদ্যোক্তার উদ্যোগের পিছনেই দেখা যাবে আত্নবিশ্বাস, সাহস, শ্রম, কর্মদক্ষতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার মনোভাব। এমনি একজন সফল উদ্যোক্তা এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জুয়েল মামুন। নিজে পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করে নিজের খরচে লেখাপড়া করছে এবং সেই উপার্জিত অর্থ থেকে পরিবারকেও সহযোগিতা করছে। তার কর্মদক্ষতা তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে। এখন আর তিনি ছোট উদ্যোগের পিছনে নয় বরঞ্চ বড় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। পরিবারের বড় সন্তান তিনি। টাংগাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার দেউলাবাড়ী ইউনিয়নের রতন বরিষ গ্রামে বাড়ী তার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপরই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে অনেক অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তার। এর কিছুদিন পর একটা স্কলারশিপ পায় সে। তখন থেকে আর কারো উপর নির্ভর করতে হয়নি মামুনকে।
ঠিক তৃতীয় বর্ষ চলাকালীন তার স্কলারশিপটা বন্ধ হয়ে যায়। পড়াশোনা ঠিক মতো চালিয়ে যাওয়া নিয়ে আবার বেশ চিন্তায় পড়েন মামুন। ঠিক তখনই ব্যবসা করার কথা চিন্তা করেন তিনি। যেই চিন্তা সেই কাজ। ২০১৮ সালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কুরিয়ারে ফরমালিন মুক্ত আম সরবরাহ করে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এরপর ব্যবসায় লাভের মুখ দেখতে পান। তখন থেকে জড়িয়ে যান বিভিন্ন ব্যবসায়। এবং বড় অংকের অর্থ উপার্জিত হতে থাকে। তার পড়াশোনা এবং সংসারের অভাব মিটিয়ে বর্তমানে নিজ বাড়ীতে গরুর খামার করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন মামুন। সততা, বিশ্বাস ও তার উপর ক্রেতাদের আস্থা তাকে সফলতা ও সামনে এগিয়ে নিয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
জানতে চাইলে মামুন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপরই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে অনেক অনিশ্চয়তা জাগে। সে সময়ে আমি অনেক স্ট্রাগল করেছি। এর মধ্যে একটা স্কলারশিপ পাই। তখন কোনরকম নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাই। যখন স্কলারশিপ বন্ধ হয়ে গেছে তখন চিন্তা করতে করতে মাথায় ব্যবসায়িক ধারণা আসে। তখন থেকে সক্রিয়ভাবে ব্যবসা শুরু করি।
তিনি বলেন, প্রথমে কুরিয়ারের মাধ্যমে আম বিক্রি দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছি। এরপর আরো কিছু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হই। বর্তমানে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় নিজ বাসায় পরিকল্পিতভাবে গরুর ব্যবসা শুরু করি। সাথে খাঁটি সরিষার তেল বিক্রি শুরু করেছি। সামনে খেজুরের গুড় বিক্রির চিন্তা আছে। এখন দেশব্যাপী আমাদের একটা মার্কেট প্লেস তৈরি হয়েছে। ক্রেতারা আমাদের উপর ভরসা করে। আমরা সেই ভরসার সঠিক মূল্যায়ন করার চেষ্টা করছি। আমাদের একটি ই- কমার্স প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলার পরিকল্পনা আছে। যেখান থেকে মানুষ নির্ভাবনায় তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে পারবে।
তিনি জানান, প্রতি আমের সিজনে প্রায় ৩০-৩৫ টন আম বিক্রি করে থাকি এবং ১০/১১ জন শ্রমিকও এই ব্যবসায় আমাদের সাথে কাজ করেন।
তার গরুর খামার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের ক্যাটেল হান্ট নামে ছোট একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এখানে সময় দিচ্ছি। বাজার ছাড়াও বিভিন্ন খামার থেকে প্রতিদিন গরু ক্রয় করছি এবং এগুলো আমাদের নিজের খামারে রেখে মোটা-তাজা করে ভালো দামে বিক্রি করছি। আমাদের কাছ থেকে এখন অনেকে গরু নিয়ে ছোট পরিসরে খামারও শুরু করেছে।
মামুন বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসা করে পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না বরং আগের তুলনায় আমার রেজাল্ট ভালো হচ্ছে এখন। সাধারণত পরীক্ষার সময় পড়াশোনার চাপ বেশি থাকে। আর আমাদের বিভাগের পরীক্ষাগুলো ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে হয়। আর এই দুমাস আমার ছোটভাই ব্যবসা দেখাশোনা করে।
মামুনকে সফল উদ্যোক্তা মনে করেছেন তার বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরিদ খান বলেন, জুয়েল মামুন আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি সে একজন সফল উদ্যোক্তা। নিজে পরিশ্রম করে পড়াশোনা করছে এবং তার পরিবারকেও সহযোগিতা করছে। আমাদের সমাজে মামুনের মতো উদ্যোক্তা প্রয়োজন। ব্যবসা করে সে তার একাডেমিক রেজাল্টও ঠিক রাখছে।
মামুন বলেন, পরিচিতজনদের উৎসাহে আমরা এখন পেশাদারিত্বের সাথে ব্যবসা শুরু করেছি। আমরা অনলাইনের মাধ্যমে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছি। সারাদেশে আমাদের অনেক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। মানুষ আমাদের ট্রাস্ট করে আমরা তা ফিল করি। আর এসব কাজের পিছনে আমার পরিবার সবসময়ই সঙ্গে রয়েছে। বর্তমানে আমি এবং আমার ছোটভাই আলমগীর এই ব্যবসা পরিচালনা করছি। আলমগীর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। আমি মনে করি কর্মই মহান।
মামুনের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে খুশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
মামুনের ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে দেড়লাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিক বলেন, মামুন দরিদ্র পরিবারে সন্তান। আমার পরিচিত মুখ। ছেলেটি খুবই উদ্যামী এবং কর্মঠ। সে পরিশ্রম করে তার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তার অসচ্ছল পিতামাতার পাশে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে সংসারের যাবতীয় খরচও বহন করছে। এসময় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের যে কোনো প্রয়োজনে সর্বদা মামুনের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।