প্রযুক্তিহিরো অফ দি ডে

ফারজানার আঁকাআঁকি

নিজের বাসার বারান্দায় বসে ছবি আঁকার ভিডিও তৈরি করেন ফারজানা আক্তার। গত মঙ্গলবার কুমিল্লা শহরেছবি: সংগৃহীত
নিজের বাসার বারান্দায় বসে ছবি আঁকার ভিডিও তৈরি করেন ফারজানা আক্তার। গত মঙ্গলবার কুমিল্লা শহরেছবি: সংগৃহীত

ফারজানার বাবা মো. জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্য। অবসর সময়ে তিনি পেনসিলে ছবি আঁকতেন। ফারজানা যখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী, তখন বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকা দেখতেন। ছবি আঁকার প্রতি ভালোবাসা সেই থেকেই। তবে কখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আঁকা শেখা হয়নি। ছবি আঁকা শিখেছেন বাবার কাছ থেকেই। ফারজানার বয়স এখন ত্রিশের আশপাশে। বিয়ে হয়েছিল কম বয়সেই। কিন্তু বিয়ের পর ছবি আঁকা থেমে যায়নি। স্বামী মো. মোস্তাফিজুর রহমানের উৎসাহে ছবি এঁকে যেতে থাকেন। একদিন মোস্তাফিজুর রহমানই ইউটিউবে ছবি আঁকা শেখানোর চ্যানেল খোলার কথা বলেন। ফারজানা বলেন, ‘তখন আমার ফ্রিল্যান্সার (মুক্ত পেশাজীবী) হওয়ার ইচ্ছা জেগেছিল। এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) ও গ্রাফিকসের কাজ শেখা শুরু করি। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে স্বামীর পরামর্শে ইউটিউব চ্যানেল খুলি।’

ফারজানা ২০১৭ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম ভিডিও নিজের ইউটিউব চ্যানেলে দেন। সেটি ছিল একটি ফলের স্কেচ করার ভিডিও। দ্রুতই ২২ হাজার গ্রাহক হলো ফারজানা ড্রয়িং একাডেমির। প্রথম বছরই পেলেন ইউটিউবের স্বীকৃতি ‘সিলভার প্লে বাটন’। এটি পাওয়া যায় এক লাখ গ্রাহক হলে। গত বছর পান ‘গোল্ড বাটন’, যা পাওয়া যায় ১০ লাখ গ্রাহক হলে।

ফারজানা বলেন, ‘চ্যানেল খোলার পাঁচ মাস পর ইউটিউব থেকে আয়ের প্রথম অর্থ পাই। সেটা ছিল ৬৫ হাজার টাকা। একই মাসে আরও ৪০ হাজার টাকা আয় করি।’ ইউটিউব চ্যানেলে বেশি ভিউ থাকলে বিজ্ঞাপন আসে। ওই বিজ্ঞাপনের অর্থের একটি অংশ পান চ্যানেলের মালিক। ফারজানা এখন বেশ ভালো পরিমাণে আয় করেন। তিনি জানান, বেশি আয় হওয়ার বড় কারণ তাঁর চ্যানেলের ভিডিও বিদেশ থেকেই বেশি দেখা হয়। শুরু করা যাক দুটি পরিসংখ্যান দিয়ে। ভিডিও শেয়ারিংয়ের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ইউটিউবের একটি চ্যানেলের গ্রাহকসংখ্যা (সাবস্ক্রাইবার) ৫৪ লাখের বেশি। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা তিনটা পর্যন্ত চ্যানেলটির ভিডিওগুলো দেখা হয়েছে ৭১ কোটিবার। যেটির কথা বলছি, সেটি ছবি আঁকা শেখানোর চ্যানেল। যিনি চ্যানেলটি চালান, তিনি বাংলাদেশের কুমিল্লার মেয়ে ফারজানা আক্তার। চ্যানেলটির নাম ফারজানা ড্রয়িং একাডেমি। এতে মূলত পেনসিল স্কেচ শেখানো হয়। ইউটিউবে যত ড্রয়িং (ছবি আঁকা) চ্যানেল রয়েছে, তার মধ্যে গ্রাহকসংখ্যার দিক দিয়ে ফারজানার চ্যানেলটি শীর্ষস্থানীয়। এ তুলনা পাওয়া যায় ছবি আঁকার জনপ্রিয় চ্যানেলগুলোর গ্রাহকসংখ্যা ঘেঁটে। তবে ইউটিউব চ্যানেলের র‌্যাঙ্কিং প্রকাশকারী দুই ওয়েবসাইট সোশ্যাল ব্লেড ও নক্সইনফ্লুয়েন্সিয়ার ডটকম জানাচ্ছে, বাংলাদেশের ইউটিউবারদের গ্রাহকসংখ্যার হিসাবে ফারজানার চ্যানেলটি দ্বিতীয়। উল্লেখ্য, বেশ কিছু চ্যানেল আছে যেগুলো বাংলাদেশি বলে পরিচিত এবং বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত। তবে সেগুলোর উৎস দেশ দেখানো হয় অন্য কোনো দেশকে।

ফারজানা থাকেন কুমিল্লা শহরে। নিজের ঘরের বারান্দায় বসে যে ভিডিওগুলো তৈরি করেন, সেগুলোর ৯৪ শতাংশ ভিউ আসে (দেখা হয়) দেশের বাইরে থেকে। সবচেয়ে বেশি দেখা হয় ভারত থেকে, ৬০ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, ইরাক প্রভৃতি দেশ।

ফারজানা  বলেন, ‘খুব কাছের কয়েকজন মানুষ ছাড়া তেমন কেউ জানে না যে আমি ইউটিউবে আঁকাআঁকি শেখাই। ইউটিউবেও অনেক দিন কেউ জানতেন না আমি কোন দেশের। ভারতীয়রা ভাবতেন আমি ভারতের, পাকিস্তানিরা ভাবতেন আমি তাঁদের দেশের। এটা নিয়ে অনেক দিন গ্রাহকদের মধ্যে তর্কও হয়েছে।’ যখন জানা গেল ফারজানা বাংলাদেশের মেয়ে এবং ভিডিওগুলো বাংলাদেশ থেকেই ছাড়া হয়, তখন সবাই বিস্মিত হন বলে জানান ফারজানা। তিনি বলেন, পরিচয় জানার পর তাঁকে উৎসাহ দেন অনেকে।সহজ কৌশলে ছবি আঁকার প্রক্রিয়া ইউটিউব ভিডিওতে দেখান ফারজানা। ভিডিওগুলোতে কথাও থাকে না। ছবি আঁকার ভিডিওর নেপথ্যে থাকে আবহ সংগীত। ফারজানার চ্যানেল এত জনপ্রিয় কেন? জবাব দিলেন ফারজানাই। তিনি বলেন, ‘খুব সহজ কৌশলে স্কেচগুলো করি আমি। ভিডিও টিউটোরিয়ালগুলোতে নানা রকম শেডের পেনসিল ব্যবহার করেন সবাই, যা অনুসরণ করে আঁকাটা তেমন সহজ নয়। আমি পাঁচ টাকা দামের সাধারণ একটি ডার্ক পেনসিল ব্যবহার করি।’ তিনি বলেন, ‘একদম যারা নতুন, তাদের জন্যই বেশি স্কেচ দিই। এ কারণে “অঙ্কন শিক্ষক” হিসেবে ইউটিউবে আমার ভালো একটি পরিচিতি গড়ে উঠেছে।’

ফারজানার বেশির ভাগ স্কেচেই দেখা যায় কম বয়সীদের মুখ। কখনো কোনো প্রাণী, কখনো প্রাকৃতিক দৃশ্য। তাঁর দুটি স্কেচের ভিডিও তিন কোটিবারের বেশি দেখা হয়েছে। দুটিতেই খুব সহজ কৌশলে ছবি আঁকা হয়েছে। বেশ কটি ভিডিও দেখা হয়েছে দুই কোটিবারের বেশি। ফারজানা মুঠোফোনের ক্যামেরা দিয়ে তাঁর ছবি আঁকার ভিডিও করেন। তিনি বলেন, ‘দিনের আলোয় ভিডিও করি। এক ঘণ্টা ধরে একটা স্কেচ করি। এর মধ্যে ৩০ মিনিট আঁকি। ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নিই।’ ভিডিও ধারণের পর সম্পাদনার কাজটিও নিজে করেন। সবকিছুর পর ১০ থেকে ১২ মিনিটের ভিডিও ছেড়ে দেন ইউটিউবে। গড়ে চার দিন পরপর একটা ভিডিও দিতে পারেন। ফারজানা বলেন, গ্রাহকেরা আরও ঘন ঘন ভিডিও দেওয়ার অনুরোধ করেন। ফারজানার বাড়ি মুরাদনগরে। জাহাঙ্গীর আলম ও কাজল রেখা দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ফারজানা। তিনি এখন কুমিল্লার সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ছেন। তাঁর স্বামী মো. মোস্তাফিজুর রহমান পেশায় ব্যবসায়ী। তাঁদের এক ছেলে সৌরভের বয়স ৯ বছর। কাগজ দিয়ে নানা কিছু বানানো শেখাতে ফারজানা’স ক্র্যাফট নামের আরেকটি চ্যানেল রয়েছে ফারজানার। কিন্তু সেটির দিকে তেমন একটা নজর দিতে পারেন না। অন্যদের ছাড়িয়ে যেতে আরও সহজ, আরও বেশি ছবি আঁকার ভিডিও তৈরির দিকেই পুরো মনোযোগ তাঁর।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button