বৈরী দেশগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রে মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষে বেশির ভাগ অঙ্গরাজ্যের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এবারের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট জো বাইডেনের মধ্যে। তবে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ভোটের ফল প্রকাশ বিলম্বিত হওয়ায় চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউজে প্রবেশের এ লড়াইয়ের চূড়ান্ত ফলাফল এখনো অনিশ্চিত। এ পরিস্থিতিতে শুধু মার্কিন ভোটাররাই না, বরং পুরো বিশ্ববাসী চূড়ান্ত ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছে। সবার আগ্রহের কেন্দ্রে একটিই বিষয়—তুমুল লড়াই শেষে কে হচ্ছেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট? এ মুহূর্তে সবচেয়ে এ প্রশ্নের উত্তরের দিকে তুমুল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে রাজনীতি ও অর্থনীতির মাঠে যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষত ট্রাম্প প্রশাসনের বৈরী দেশগুলোও। এ তালিকায় রয়েছে চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়ার মতো দেশগুলো। কেননা হোয়াইট হাউজের রদবদলে স্বাভাবিকভাবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্ভাব্য সম্পর্কে প্রত্যেকটি দেশকে নতুন করে ভাবতে হতে পারে।
রাশিয়া: রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আগে থেকেই বেশ চাপের মধ্যে রয়েছেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরোধীদের ক্রম-উত্থান, বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনিকে বিষ প্রয়োগসহ নানা ইস্যু সক্রিয় রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আর্মেনিয়া-আজারবাইজানের মধ্যকার যুদ্ধে মধ্যস্থতা, সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে সমর্থন ও সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করা নিয়ে পুতিনকে ভাবতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে করোনা মহামারীতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপ সামলানো।
এতসব চিন্তার মাঝেও বৈশ্বিক রাজনীতি-অর্থনীতিতে অবস্থান পোক্ত করার উচ্চাভিলাষ পুতিনের চোখ মার্কিন নির্বাচনের দিকে আটকে রেখেছে। যদিও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের মতো জোরালো অভিযোগ এবার নেই। তার পরও পুতিন ক্ষুধার্ত ভালুকের মতো তাকিয়ে রউবেন। কেননা হোয়াইট হাউজে যিনিই আসুন না কেন, পুতিনকে পরবর্তী চার বছর তার বিরুদ্ধে অম্লমধুর লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
উত্তর কোরিয়া: ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলা হয় আনপ্রেডিক্টেবল পারসন। তিনি চমকে দিতে পছন্দ করেন। কখন কী বলবেন, কী করবেন তা আগে থেকে আন্দাজ করা কঠিন। একই কথা বলা যায় উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং-উনের ক্ষেত্রেও। তবে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে দুই নেতার মধ্যে একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অবিশ্বাস অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। উত্তর কোরিয়ার সাথে সম্পর্ক তুলনামূলক সহজ করা ট্রাম্পের বড় একটি সফলতা বিবেচনা করা হয়।
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে এ কূটনীতি এগিয়ে নেয়া ট্রাম্পের জন্য সহজ হবে। আর বাইডেন ক্ষমতায় এলে পুরো প্রক্রিয়াটি নতুন করে ভাবতে হতে পারে। এজন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফলের প্রতি আগ্রহ পিয়ংইয়ংয়ের। কেননা ট্রাম্প কিংবা বাইডেন দুজনের মেয়াদে ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে অগ্রযাত্রা ভিন্নভাবে এগিয়ে নেবেন কিম জং-উন।
ইরান: ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে বেশ ভুগেছে ইরান। ছয় জাতির পারমাণবিক চুক্তি থেকে ওয়াশিংটনের নাম প্রত্যাহার ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চাপে জর্জরিত হয়েছে ইরানের অর্থনীতি। এ কারণে হোয়াইট হাউজে পরিবর্তন ঘটলে তেহরান বরং খুশি হবে। কেননা মধ্য-বামপন্থী বাইডেনের হাত ধরে সম্পর্কোন্নয়নের পাশাপাশি পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরার পথ প্রশস্ত হওয়ার প্রত্যাশা করছে তেহরান, যা করোনা-পরবর্তী বিশ্বে ইরানের অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরিয়ে দেবে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইসরায়েল ভীতি কমিয়ে আনতে তেহরানের কাছে ট্রাম্পের তুলনায় বাইডেন কার্যকর বিকল্প। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলের দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে ইরান সরকার।
চীন: ২০১৬ সালের পর থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মূল শত্রু যেন ছিল চীন। ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যকার একের পর এক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিরোধ বিশ্বকে রীতিমতো দুই মেরুতে বিভক্ত করে ফেলেছে। ট্রাম্পের হাত ধরে শুরু হওয়া বাণিজ্যযুদ্ধ বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্কের প্রধান প্রতিবন্ধক। রয়েছে জল ও স্থলে ভূরাজনৈতিক বিরোধ। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তি খাত থেকে শুরু করে নানা ইস্যুতে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়া নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিযোগিতা।
এসব কারণে মার্কিন নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে বেইজিং। কেননা ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে চীনের বিরুদ্ধে আরো আগ্রাসী নীতি নেবেন, এটা অনুমেয়। বিপরীতে বাইডেনের হাত ধরে চীন নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতি কিছুটা নমনীয় হতে পারে। ফলে আগামী দিনগুলোয় বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতিতে চীন-মার্কিন সম্পর্ক এবং এ বিষয়ে চীনা প্রতিক্রিয়া সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে ফলাফলের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে।
এখন শুধু অপেক্ষা চূড়ান্ত ফলাফলের। পরিবর্তনের স্লোগান দেয়া জো বাইডেন হোয়াইট হাউজে ঢুকবেন, নাকি আমেরিকার পুনঃশ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ডোনাল্ড ট্রাম্প আরেক মেয়াদে কর্তৃত্ব করবেন এ ঘোষণার অপেক্ষায় বিশ্বজুড়ে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে সবাই। বর্তমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করা কিংবা প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে মুখে কুলুপ এঁটেছে চীন, রাশিয়া, ইরানের মতো দেশগুলো। নিশ্চুপ থাকাই যেন এ মুর্হূতে সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ কূটনীতি।
দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ও পলিটিকো অবলম্বনে