করোনাকালে প্রবাসী আয়ে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ পাকিস্তান ও মেক্সিকো
নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য প্রবাসী কাজ হারিয়েছেন। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে শ্রমশক্তি রফতানিকারক দেশগুলোয়। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মেক্সিকো। কাজ হারিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরা ফিরে এলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ না কমে উল্টো বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে এ তিন দেশে। বিশ্বব্যাংক ও নোম্যাডের এক প্রতিবেদন বলছে, কভিড-১৯ পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) বড় গন্তব্য প্রায় সবক’টি দেশেই রেমিট্যান্স প্রবাহ নেতিবাচক ছিল। এই সময়ে প্রবাসী আয় কমেছে ভারত, শ্রীলংকা ও ইন্দোনেশিয়ারও। তবে এ পরিস্থিতি এড়াতে পেরেছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মেক্সিকো। শুধু তা-ই নয়, পরের প্রান্তিকে রেমিট্যান্সে বড় প্রবৃদ্ধিও পেয়েছে দেশ তিনটি।
রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রতি মাসেই নতুন রেকর্ড গড়ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেকর্ড ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান প্রবাসীরা। এরপর আগস্টেও ১৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স দুই বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলারে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসীরা ৬৭১ কোটি ৩১ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৫১ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস, ২০২০ সালে ৮ শতাংশ বেড়ে বাংলাদেশে ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসতে পারে। এর আগে এপ্রিলের শুরুতে কভিড-১৯-এর কারণে এ বছর বাংলাদেশে রেমিট্যান্স ২২ শতাংশ কমে ১৪ বিলিয়ন ডলারে নামতে পারে বলে ধারণা দিয়েছিল সংস্থাটি। তবে গত শুক্রবার প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, মহামারীর কারণে বেশির ভাগ দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে ধস নামলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৩ শতাংশ। এটা আরো বেড়ে ২০২০ সালে প্রবাসী আয়ে বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে থাকবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার পেছনে আরো বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ তুলে ধরেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশের মুসলিম প্রবাসীরা হজের জন্য টাকা জমিয়ে রাখেন। কিন্তু মহামারীর কারণে এবার হজ বন্ধ থাকায় তারা সেই টাকা দেশে পাঠিয়েছেন। এ বছর দেশব্যাপী হওয়া দীর্ঘমেয়াদি বন্যাকেও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বন্যায় প্রায় ১০ লাখ ঘরবাড়ি ও ৪৭ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রবাসী স্বজনরা বেশি টাকা পাঠিয়েছেন। এছাড়া মহামারীর মধ্যে এপ্রিল-জুন সময়ে শাটডাউনের কারণে অর্থ জমে যাওয়া ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় অনানুষ্ঠানিক (হাতে হাতে বহন) থেকে আনুষ্ঠানিক বৈধ পথে (ব্যাংকের মাধ্যমে) অর্থ আসাকেও রেমিট্যান্স বাড়ার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক। অন্যদিকে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে সরকার যে ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, প্রবৃদ্ধিতে তারও ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশের মতো প্রবাসী আয়ে একই রকম প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে পাকিস্তান ও মেক্সিকোতেও। করোনা মহামারীর ছয় মাস পর গত শুক্রবার বিশ্ব রেমিট্যান্স পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘কভিড-১৯ ক্রাইসিস থ্রো মাইগ্রেশন লেন্স’ শীর্ষক হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে মেক্সিকোয় রেমিট্যান্স প্রবাহে ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রবৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত ছিল দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকেও। দেশটিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার পেছনে ডলারের বিপরীতে পেসোর অবমূল্যায়নকেই বড় কারণ মনে করছে বিশ্বব্যাংক। আর পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ‘হজ বন্ধের প্রভাব’ ও কর মওকুফকে রেমিট্যান্স বাড়ার কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।
অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ড. সি আর আবরার এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় কাজ করেছে। অনেক প্রবাসী তাদের জমানো যে টাকা ছিল, সেগুলো দেশে পাঠাচ্ছেন। আবার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সব সময় বিভিন্ন দেশ থেকে ভিসা কেনাবেচা করত, সেগুলো কিন্তু এখন বন্ধ। এ বাবদ অর্থ লেনদেন বন্ধ থাকায় হুন্ডি বন্ধ। ফলে সঠিক চ্যানেলে টাকাগুলো দেশে আসছে। এটা কতদিন অব্যাহত থাকবে সেটিও ভাববার বিষয়।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাসী আয় গত বছরের তুলনায় ৪ শতাংশ কমতে পারে। আর ২০২১ সালে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। ওই বছর প্রবাসী আয় কমতে পারে ১১ শতাংশ। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চিত্রটা খারাপ। সার্বিকভাবে, ২০২১ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বে প্রবাসী আয় কমবে ১৪ শতাংশ। গত এপ্রিলের প্রতিবেদনে, এটা ১৫ শতাংশ হওয়ার আভাস দেয়া হয়েছিল।
প্রবাসী আয়ের পরিমাণের দিক থেকে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম। প্রথম স্থানে আছে ভারত (৭৬ বিলিয়ন ডলার), দ্বিতীয় স্থানে চীন (৬০ বিলিয়ন ডলার), তৃতীয় স্থানে মেক্সিকো (৪১ বিলিয়ন ডলার)। তবে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপির) রেমিট্যান্সের অবদান বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চতুর্থ; জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। এক্ষেত্রে ২৩ শতাংশ নিয়ে প্রথম স্থানে আছে নেপাল, ৯ দশমিক ১ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে পাকিস্তান, ৮ দশমিক ২ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় স্থানে শ্রীলংকা।