অর্থনীতি

বিদ্যুৎ খাতে চীনাদের প্রভাব বাড়ছে

মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশই আসবে পায়রা প্রকল্প থেকে

jkদেশে কয়লাভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের কাজ চলছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ‘পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প’। এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এরই মধ্যে উৎপাদনে এসেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ হাজার ৩৪০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। সব মিলিয়ে পায়রা প্রকল্প থেকে মোট ২ হাজার ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৪ সাল নাগাদ পায়রায় দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শেষ হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির গড় বার্ষিক অন গ্রিড বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পূর্ণ লোডে ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন কিলোওয়াটে পৌঁছবে, যা হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ।

২ হাজার ৬৬০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপারক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের সব ইউনিট যখন উৎপাদনে আসবে, তখন সক্ষমতার বিচারেও দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ১০ শতাংশ পায়রার দখলে থাকবে। কারণ চলতি বছরের অক্টোবর নাগাদ দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সাল নাগাদ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ২৪ হাজার মেগাওয়াট। পুরনো কেন্দ্রের পাশাপাশি নতুন কিছু কেন্দ্র উৎপাদনে আসায় সক্ষমতা এরই মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

পটুয়াখালীর পায়রায় দেশের সবচেয়ে বড় ২ হাজার ৬৬০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপারক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি এক্সপোর্ট ইমপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) ও বাংলাদেশের নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড। এটি ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর একটি ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসার জন্য চলতি বছরের ৭ এপ্রিল নির্ভরযোগ্য পরিচালনা কার্যক্রম নিরীক্ষা শুরু হয়। এরপর প্রায় এক মাস এটি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তত্ত্বাবধানে থাকে। এরপর গত ১৫ মে বিপিডিবির অনুমোদনক্রমে ওইদিন থেকেই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যায় কেন্দ্রটি। উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়।

মার্চের শুরুতেই প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদনের কথা থাকলেও দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় উৎপাদন পিছিয়ে যায়। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত চীনা প্রকৌশলীরা নিজ দেশে চলে যাওয়ায় প্রস্তুত হওয়ার পাঁচ মাস পর উৎপাদনে আসে প্রথম ইউনিট।

করোনার কারণে মেগা প্রকল্পগুলোতে ধীরগতি নেমে আসায় প্রকল্প এগিয়ে নিতে রিশিডিউল করা হয়। ফলে গতি ফিরে পায় বড় বড় প্রকল্প। পরিকল্পনা অনুযায়ী, জুনে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও বিলম্বিত হয়। পরে গত ২৬ আগস্ট দ্বিতীয় ইউনিট (৬৬০ মেগাওয়াট) পরীক্ষামূলক উৎপাদনে আসে। পুরো কেন্দ্র এখন বাণিজ্যিক উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে।

পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শাহ আবদুল মাওলা বলেন, দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেছে। আমরা অফিশিয়ালি বিপিডিবিকে চিঠি দিয়ে অবহিত করেছি। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হলেও যথাসময়ে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে পারেনি সরকার। ফলে প্রথম ইউনিটের উৎপাদিত বিদ্যুৎ গোপালগঞ্জ সাব-স্টেশনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে।

পায়রা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পটুয়াখালী থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ১৬০ কিলোমিটার ডাবল সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়। এ লাইনের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে এ বিদ্যুৎ ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য ১৬৪ কিলোমিটার আমিনবাজার-মাওয়া-গোপালগঞ্জ-মোংলা ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। সাড়ে নয় কিলোমিটার নদী এবং করোনা মহামারীর কারণে এ প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা বাড়িয়ে ২০২১ সাল নাগাদ লেগে যাবে বলে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে পায়রায় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও সিএমসির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী দুই কোম্পানি চায়না-বাংলাদেশ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড গঠন করে। এরপর ২০১৬ সালে প্রকল্পটি পরিবেশগত ছাড়পত্র পায়। ২০১৭ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০০ কোটি ডলার চুক্তিতে বাংলাদেশ ও চীনের সমান অংশীদারিত্বে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিদিন প্রায় ১৩ হাজার টন কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। এ প্রকল্পে মোট ছয় হাজার কর্মী কাজ করছেন, যার মধ্যে ২ হাজার ৭০০ জন চীনা শ্রমিক ও প্রকৌশলী রয়েছেন।

জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বড় বড় দেশ যখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসছে, তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে পরিবেশ বিপর্যয়কারী বড় বড় কয়লাভিত্তিক মেগা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে সরকার। ধারণা অনুযায়ী আগামীতে দেশের মোট বিদ্যুতের অর্ধেক থাকবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দখলে।

এ বিষয়ে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম  বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে এসব লক্ষ্যমাত্রা দেখিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে মুনাফা লুটে নেয়া হচ্ছে। বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন একদিকে যেমন অর্থ অপচয় করছে, অন্যদিকে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র বানিয়ে পরিবেশ নষ্টের পাঁয়তারা চলছে।

দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কয়লাভিত্তিক ১৬টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে পায়রার তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশে সবচেয়ে বড় এ প্রকল্প নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এল।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button