১১২ দিন পর লকডাউনমুক্ত হচ্ছে মেলবোর্ন
অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষানগরী ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের মেলবোর্নে করোনার কারণে চলা অচলাবস্থার অবসান হচ্ছে। ১১২ দিন লকডাউনে থাকার পর মানুষ পেতে যাচ্ছে মুক্তির স্বাদ। আর তাই মানুষের মাঝে উৎসবের আমেজ। জেগে ওঠার অপেক্ষায় ক্ষণগণনা করছেন সাধারণ মানুষ। লকডাউনের কারণে গোটা অস্ট্রেলিয়ায় চলা বসন্তের রূপ-রস-উত্তাপ কোনোটাই উপভোগ করতে পারছিল না মেলবোর্নের মানুষ। কোভিড-১৯ থমকে দিয়েছিলে ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের ৫৫ লাখ মানুষকে। এরপর ১১২ দিনের কঠোর লকডাউন এবং জনগণকে বিধি-নিষেধ মেতে চলতে বাধ্য করে রীতিমতো বধ করা হয়েছে কোভিড-১৯ নামের ছোঁয়াচে দৈত্যকে।
দুদিন ধরে ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যে নতুন করে কোনো করোনা রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়নি, মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেনি। সরকারের ঘোষণা ছিল, দৈনিক করোনা রোগীর গড় সংখ্যা পাঁচজনে নামলেই কেবল লকডাউন থেকে মুক্তি মিলবে। যদিও লকডাউন তুলে নেওয়ার জন্য ক্রমেই ভিক্টোরিয়া সরকারের ওপর চাপ বাড়ছিল। তবে কোনো চাপে নতি স্বীকার করছিলেন না অঙ্গরাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর মূল নজর ছিল রোগীর সংখ্যার ওপরই।
যদিও নগরীর নানা স্থানে ক্লাস্টারের সন্ধান মেলার পর এক দফা পেছানো হয় লকডাউনমুক্ত হওয়ার ঘোষণা। সবশেষ করোনা রোগীর সংখ্যা শূন্যে নামার ইতিবাচক খবরের পর, ভিক্টোরিয়ার মুখ্যমন্ত্রী ড্যানিয়েল অ্যান্ড্রুস স্থানীয় সময় সোমবার দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে সবকিছু খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী স্থানীয় সময় বুধবার সকাল থেকে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান খুলে যাবে মেলবোর্নে।
ঘোষণায় মুখ্যমন্ত্রী আরো জানান, ২৭ অক্টোবর মধ্যরাতের পর মেলবোর্নের মানুষ মুক্তভাবে বাসা থেকে বের হতে পারবেন।
আরো জানানো হয়, দুজন মানুষ তাদের সন্তানদের নিয়ে আরেকটি বাসায় দিনে একবারই যেতে পারবেন। এ ছাড়া একটি বাসার ভেতরে বাইরের দুই পরিবার এক সঙ্গে জড়ো হতে পারবেন না।
আরো বলা হয়, দোকানপাট, ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, পাব ও বারসহ সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে যাবে। তবে এক ছাদের নিচে ১০ জনের বেশি মানুষ বসা যাবে না। খোলা আকাশের নিচে প্রয়োজনে ১০ জন বসতে পারবেন। এ ছাড়া কোনো বিয়েতে একসঙ্গে ১০ জন হাজির হতে পারবেন এবং মৃতের সৎকার অনুষ্ঠানে ২০ জন উপস্থিত থাকতে পারবেন।
বাসা থেকে ২৫ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে ভ্রমণে বিধি-নিষেধ থাকলেও সরকারের আশা, ৮ নভেম্বরের পর সেই বিধিও তুলে নেওয়া হবে। সেই সময়ে খুলে যাবে জিম ও ফিটনেস স্টুডিওগুলো।
মূলত গাণিতিক হিসেবের ভিত্তিতে লকডাউন পরিচালনা হলেও, দুই থেকে তিনটি এলাকায় করোনা ক্লাস্টার ধরা পরায় লকডাউন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তের জন্য সময় নেয় অঙ্গরাজ্য সরকার।
ভিক্টোরিয়ার লেবার সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল, যেকোনো মূল্যে বড়দিনের আগে গোটা অঙ্গরাজ্যকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া এবং গোটা অর্থনীতি সচল করা। সেই লক্ষ্যে অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ড্যানিয়েল অ্যান্ড্রুসকে সফল বলেই মনে করছেন মেলবোর্নবাসী।
এদিকে করোনা রোগীর সংখ্যা শূন্য হওয়ায় অন্য সবার মতো মুখ্যমন্ত্রী ড্যানিয়েল অ্যান্ড্রুস ‘ডোনাট’ সামনে নিয়ে দিনটি পালন করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ডোনাট’ সামনে নিয়ে তাঁর ছবি প্রকাশ পাওয়ার পর, ধুম পড়ে ডোনাট কেনার। শপিংমলগুলোতে ডোনাটের সংকট দেখা দেয়।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, মেলবোর্নে লকডাউন দেওয়ার পরপরই দেখা দিয়েছিল টিস্যু পেপারের সংকট। আর ডোনাট সংকটের মধ্যদিয়ে শেষ হচ্ছে লকডাউন।
লকডাউনের পরিসমাপ্তির খবরে জমজমাট হতে শুরু করেছে খাবারের দোকানগুলো। মেলবোর্নের একটি এলাকা ক্লেটনের ‘জাস্ট ইটালি’ নামের এক পিৎজা শপে গিয়েছিলাম সোমবার। রেস্টুরেন্ট মালিক জর্জ বলছিলেন, লকডাউন শেষ হওয়ার খবর জানার পর তাঁর পিৎজা শপে ফোন করে টেবিল বুক করছেন মানুষ। ফোন ধরে টেবিল বুকের হিসাব মেলাতে তিমি হিমশিম খাচ্ছেন। তবে দীর্ঘ সময় বন্ধের পর আবার যে শপ চালু হচ্ছে, তাতে তিনি দারুণ খুশি।
কথা হচ্ছিল মেলবোর্নের বাসিন্দা বিজন সরকারকে সঙ্গে। গাড়িতে গোটা অস্ট্রেলিয়া ঘোরার পরিকল্পনা নতুন করে সাজাচ্ছেন বলে জানালেন তিনি। লকডাউনের প্রস্থান কীভাবে উৎযাপন করবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে বিজন জানালেন, আপাতত বারবিকিউ পার্টি করা আর সপ্তাহান্তে পরিবার নিয়ে সমুদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করছেন তিনি। আন্তঃঅঙ্গরাজ্য সীমানা খুললে মেলবোর্ন থেকে রাজধানী ক্যানবেরা আর সিডনি ঘুরে দেখার পরিকল্পনার কথা জানালেন তিনি।
অন্যদিকে, মেলবোর্নের ডেনডেনংয়ের বাসিন্দা ইমরান চৌধুরী অবশ্য অতি সতর্ক। তাঁর মতে, লকডাউন তুলে দেওয়ার পর দুই সপ্তাহ সতর্কই থাকতে হবে। কেননা মুক্ত স্বাধীন মানুষের উচ্ছ্বাসের কারণে হয়তো আবার কোভিড-১৯ বেড়ে যেতে পারে।
লকডাউন তুলে নেওয়ার খবরে স্বস্তির কথা জানালেন ওকলির বাসিন্দা জেসমিন আরা সুলতানা। তাঁর মতে, বাইরে বেরুতে না পারা, স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে না পারার কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয়েছিল, লকডাউন উঠে গেলে ঘরে পার্টি দিয়ে তা আবার পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
লকডাউনের পরিসমাপ্তি ঘোষণার দুই সপ্তাহ আগেই অবশ্য খুলে দেওয়া হয় এ অঙ্গরাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। ক্লাসরুমে ফিরে আসায় খুশি শিক্ষার্থী আর শিক্ষকরা। ফলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে শুরু করেছে মেলবোর্নে।
অভিজ্ঞজনরা এও বলছেন, সারা বিশ্বে যখন করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভ আঘাত হানছে, লকডাউনে ফিরছে ইউরোপের নানান দেশ, তখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সফলভাবে মোকাবিলা করেছে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তর নগরী মেলবোর্ন।
লকডাউনের পরিসমাপ্তি, নানা বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ার ঘোষণা এলেও, মুখে মাস্কের ব্যবহারের বিধিতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। সুতরাং, করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত মেলবোর্নে মাস্ক পরার বিধি থাকছেই।