ঋণ বিতরণ ৮০% কমেছে ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ও আশার
গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয় তার ৭০ শতাংশেরও বেশি অর্থের জোগান দেয় বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও খাত। ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমেই কৃষি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগে গ্রামীণ পরিবারগুলোকে অর্থায়ন করে এনজিওগুলো। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনার আঘাতে অন্য সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মতো থমকে যায় এনজিওগুলোর ঋণ কার্যক্রমও। আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় ঋণ বিতরণ ও আদায়।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থায়নে বড় ভূমিকা রয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় তিনটি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, আশা ও গ্রামীণ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) এ তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই ঋণ বিতরণ কমেছে ৮০ শতাংশের বেশি। একই সঙ্গে ৭৫ শতাংশের বেশি কমেছে ঋণ আদায়।
চলতি বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। দেশে প্রথম কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় মার্চের ৮ তারিখ। এর পর থেকেই সংকুচিত হতে থাকে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রম। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হলে ঋণের কিস্তি আদায় ও বিতরণ একপ্রকার বন্ধই হয়ে যায়, যার প্রতিফলন ঘটেছে গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন) ঋণ বিতরণ ও আদায়ের চিত্রে।
দেশের শীর্ষ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। সবচেয়ে বড় এনজিও হিসেবে বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুনাম রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে গড়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ব্র্যাক। এর মধ্যে তৃতীয় প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। কিন্তু করোনার কারণে অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে তা ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ আগের প্রান্তিকের তুলনায় শেষ প্রান্তিকে ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ৮১ দশমিক ৫২ শতাংশ।
কভিডকালে ঋণ বিতরণ ও আদায়ে নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে ব্র্যাক। প্রথাগত কার্যক্রমের বাইরে নতুন ও ইনোভেটিভ কর্মসূচির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শুরু করেছে সংস্থাটি। সেসব কার্যক্রমের মাধ্যমে ঋণ বিতরণে গতিও এসেছে। তবে আদায় কার্যক্রম পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শিগগিরই আদায় কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে বলে জানিয়েছেন ব্র্যাক মাইক্রো ফাইন্যান্সের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা শামস আজাদ। তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ে গ্রাহকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি যে গ্রামীণ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে এখনই প্রচুর অর্থায়ন প্রয়োজন। অনেক গ্রাহকই ঋণ পেলে খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। এজন্য আগের ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি কিন্তু ঋণ নিতে সক্ষম এমন প্রায় আড়াই লাখ গ্রাহককে রিফাইন্যান্সিং কার্যক্রমের মাধ্যমে ঋণ প্রদান করেছে ব্র্যাক। এ কর্মসূচির ফলে এখন অনেকে দুটো ঋণই পরিমিত মাত্রায় শোধ শুরু করেছেন। ফলে সার্বিকভাবে ঋণ আদায় ও বিতরণে যে গতিহীনতা তৈরি হয়েছে সেটি থেকে ব্র্যাক দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারবে বলে আশা করছি।
করোনার আঘাতে ঋণ বিতরণ ও আদায় থমকে যায় দেশের আরেক শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশার। প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে গড়ে ৮ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ প্রান্তিক বা এপ্রিল-জুন সময়ে এটি মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ৮৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে আশার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও আশা ইন্টারন্যাশনালের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মো. এনামুল হক বলেন, দেশের অর্থনীতিকে দ্রুত আগের অবস্থানে ফিরতে সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে এনজিওগুলো, যারা কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা অন্যান্য নানা উদ্যোগে ঋণ বিতরণ করে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে সামনের দিনে প্রতিষ্ঠানগুলোর মন্দ ঋণ বাড়তে পারে। এতে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো আরো রুগ্ণ হতে পারে। তবে আশার ঋণদান কার্যক্রম সম্পূর্ণ সদস্য ও নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হয়। বৈদেশিক নির্ভরতা একেবারেই নেই বললেই চলে। তারল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। অন্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় আশাতে একটি স্বাতন্ত্র্য অবস্থা বিরাজ করায় কভিড সংকট খুব ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারবে তারা।
দেশের আরেক শীর্ষ বেসরকারি সংস্থা গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রমেও বড় আঘাত হেনেছে করোনা। প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে গড়ে ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে শুধু তৃতীয় প্রান্তিকেই বিতরণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। কিন্তু মার্চে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ১ হাজার ২৯০ কোটি টাকায় নেমে আসে। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ।
ঋণ বিতরণের পাশাপাশি ঋণ আদায়ে ভাটা পড়েছে এনজিওগুলোর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সার্বিকভাবে প্রায় ৯৬ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা আদায় হলেও গত অর্থবছরে আদায় হয়েছে মাত্র ৮২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে তার আগের প্রান্তিকের তুলনায় ঋণ আদায় কমেছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। তৃতীয় প্রান্তিকে ব্র্যাক, আশা ও গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ আদায়ের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা, যা শেষ প্রান্তিকে ৫ হাজার ৫৯০ কোটি টাকায় নেমে আসে। এর মধ্যে ব্র্যাকের ঋণ আদায় ৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা থেকে ২ হাজার ৬০ কোটি টাকা, আশার ৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা থেকে ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা