ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের জন্য অবৈধভাবে যাওয়া বাংলাদেশিরা এখন বসনিয়ার জঙ্গলে মানবেতর জীবনযাপন করছে। দালালের মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে যাওয়া এসব যুবক কুকুরের কামড়সহ অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া দুই শতাধিক বাংলাদেশির ইউরোপের স্বপ্ন এখন বসনিয়ার জঙ্গলে বন্দি। তাদের অধিকাংশই সিলেটের বলে জানা গেছে। ইউরোপীয় মুদ্রা উপার্জনের আশায় ৮ থেকে ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করে এসব লোক যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়া পার্শ্ববর্তী দেশ বসনিয়া সীমান্তের প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে মিরাল ক্যাম্পে স্থান হয়েছে ইউরোপ অভিবাসী প্রত্যাশী বাংলাদেশিদের। যেখানে রয়েছেন বৃহত্তর সিলেটের সাইফুর, শফিক, নিখিল, সোহেল, শায়েলরা।
জাতিসংঘের ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা’ আইওএম মিরাল ক্যাম্পটি পরিচালনা করে। আইওএম’র মতে, ক্যাম্পে সাতশ’ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মধ্যে ৫০ শতাংশ পাকিস্তানি অভিবাসনপ্রত্যাশী। বাংলাদেশিদের হার ২৮ শতাংশ। এছাড়া মরক্কো, আফগানিস্তান, সিরিয়া, আলজেরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীরাও আছেন।
সম্প্রতি বসনিয়ার জঙ্গলে আটকে থাকা এসব বাংলাদেশিকে নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন করেছে ডয়েচে ভেলে বাংলা। সেখানে আটকেপড়া ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশিরা জানিয়েছেন তাদের হতাশার কথা। তারা জানান, পানি সংকট, শীতের সমস্যা ও ক্রোয়েশিয়া পুলিশের নির্মম নির্যাতনের কাহিনী। দালালদের খপ্পরে পড়ে এখন মানবেতর জীবনযাপনের কথা। এ ক্যাম্পে থাকা সিলেটের সাইফুর, শফিক, নিখিল, সাইফুর, সোহেল ও শায়েলের ডয়েচে ভেলেকে দেয়া প্রতিক্রিয়া নিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রতিবেদনটি।
সিলেটের শফিক মিয়া জানান, তার ডান হাতে কুকুরের ১৪টি কামড় রয়েছে। একটি রগ কেটে গেছে একেবারেই। হাতে এখন আর শক্তি পান না। পুলিশের কুকুর কামড়ে তার এই অবস্থা করেছে। চার মাস মিরাল ক্যাম্পে আছেন। এরই মধ্যে তার কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ফলে দেশে ফেরার সুযোগও আর দেখছেন না। সুস্থ হয়ে উঠলেই আবার সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করবেন বলে জানান শফিক।
সিলেটে রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার হয়ে এখন বসনিয়ার মিরাল ক্যাম্পে আছেন বলে দাবি করেন শায়েল আহমেদ। তিনি জানান, গ্রিস ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হলেও সেখান থেকে অন্য দেশে যাওয়া বেশ কষ্টকর। বাধ্য হয়ে বসনিয়া হয়ে ইতালি বা ফ্রান্স যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
সুনামগঞ্জের নিখিল ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত পার হওয়ার সময় পুলিশের নির্মম নির্যাতনের চিত্র দেখান সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে। জাতিসংঘের অভিবাসীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএম তাকে সীমান্ত থেকে নিয়ে আসে। এখন মিরাল ক্যাম্পে থাকা নিখিলের সারা গায়ে রয়েছে পুলিশের লাঠির বাড়ির দাগ। মৌলভীবাজারের শেখ লাকী জানান, ‘গেমে’ গিয়ে স্লোভেনিয়া পুলিশের হাতে আটকা পড়েন তিনি। বসনিয়ায় ফেরত পাঠানোর আগে সীমান্তে তাকে ক্রোয়েশিয়া পুলিশ মারধরও করে। ওমানে পাঁচ বছর কাটিয়েও দেশে পরিবারকে তেমন একটা আর্থিক সাহায্য করতে না পারায় পরিবারের কথা চিন্তা করে ফ্রান্সে যেতে চেয়েছিলেন লাকী। খরচ হয়ে গেছে ১৭ লাখ টাকা।
সিলেট থেকে বসনিয়া যাওয়া সাইফুর রহমান জানান, তার এ পর্যন্ত ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ওমান-দুবাই সাগর পাড়ি দিয়ে আসার পর এখন দেশে ফেরার চিন্তা করছেন তিনি।
সিলেট শাহপরানের সোহেল জানান, সবকিছু জেনেই ১৮-২০ লাখ টাকা খরচ করে তিনি এ পথে রওনা দিয়েছেন। তাকে দালালরা আগেই বলেছে, ‘প্রথমে ইরান যেতে হবে, এরপর নানা পথ পেরিয়ে তুরস্ক হয়ে ইতালি পৌঁছতে হবে। আমার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান কোনো কিছুই থাকবে না, এগুলো আমি জেনেই আসছি।’
এদিকে ইতালি বা ফ্রান্সে প্রবেশের জন্য বসনিয়ার জঙ্গলে আটকে থাকা বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। সম্প্রতি কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জঙ্গলে অবস্থান করা বাংলাদেশিদের করুণ চিত্র ফুটে ওঠে।