এন্টারটেইনমেন্ট

ঋত্বিক ঘটকের ডকু ফিল্ম যেভাবে ইন্দিরা গান্ধীর অনুমোদন পেয়েছিল

ggছবিটি মুক্তির জন্য ঋত্বিক ঘটক স্বয়ং দেখা করেন ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। নানা বাধা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত ছবিটি মুক্তি পায়। আর এজন্য সিনেমাপ্রেমীরা এবং ঋত্বিক ঘটকের ভক্তরা ধন্যবাদ জানাতে পারেন ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পিএন হাকসারকে। ছবিটিকে ছাড়পত্র দিতে হাকসারই ইন্দিরা গান্ধীকে রাজি করিয়েছিলেন

১৯৭০ সালে পালিত হয়েছিল রুশ বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের জন্মশতবর্ষ। এ উপলক্ষে অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে লেনিনের ওপর ২০ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাণ করেছিলেন কিংবদন্তি বাঙালি পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। সাদা-কালো এ ছবি নির্মিত হয়েছিল লেনিন ও সমাজতন্ত্র বিষয়ে ঋত্বিক ঘটকের ভাবনার ওপর ভিত্তি করে। ছবিটি নির্মাণের পর অবশ্য ঝামেলা বেধেছিল। বেশ কিছুদিন এটি ভারতে মুক্তির অনুমতি পায়নি।

‘আমার লেনিন’ ছবিটির বিষয়বস্তু ছিল জোতদারদের শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার এক গ্রামের কৃষকদের প্রতিবাদ। এ কৃষকরা জানেন না লেনিনের পরিচয়। অক্টোবর বিপ্লব বা রুশ বিপ্লবের সঙ্গেও তারা পরিচিত নন। কিন্তু তার পরও লেনিন তাদেরই, তারা বলে ওঠেন, ‘আমার লেনিন’। গাঁয়ের এক ভূমিহীন তরুণ লেনিনের লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়। তারপর সে শোনে কলকাতায় লেনিনের জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। তা দেখতে সে কলকাতা যায়। সেখানে গিয়ে লেনিনের রাজনীতি সম্পর্কে আরো কিছু জেনে ফিরে আসে তার গাঁয়ে। ভূমিহীনদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের নিয়ে দখল করে জমি। আমার লেনিনের ধারাভাষ্যে শোনা যায় এসবই লেনিনের নির্দেশ। গ্রামের ভূমিহীনরা লেনিনের নির্দেশ মেনেই যা করার করছে। লেনিন তাদের ভরসা, তাই তারা সুদূর রাশিয়ার মানুষটিকে আপন করে নেয়। এ লেনিন তাদের নিজেদের লেনিন, গ্রামের সেই ভূমিহীন তরুণটিই তাদের লেনিন। বলাবাহুল্য সেটা সত্তরের দশক। ভারতে নকশাল আন্দোলন তখনো শক্তিশালী। ঋত্বিক ঘটকের আমার লেনিন ছবিতে ভূমিহীনদের জমি দখলের অংশটি যে কাউকে সে সময়ের নকশাল আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বকেই স্মরণ করিয়ে দিতে বাধ্য। ভারতের সেন্সর বোর্ড নিশ্চয়ই এ অংশটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিল।

আমার লেনিন নির্মাণের পর তত্কালের সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পিপল’স রিপাবলিক অব পোল্যান্ড থেকে ঋত্বিক ঘটকের কাছে অনুরোধ আসে দেশগুলোতে ছবিটি প্রদর্শনের। কিন্তু ভারতের ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্সরশিপ বোর্ড আমার লেনিন ডকু ফিল্মটিকে নিষিদ্ধ করে।

সেন্সর বোর্ডে আমার লেনিন আটকে যাওয়ার বিরুদ্ধে মুখ খোলেন অনেকে। তথ্যচিত্রটি নিয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এতে স্বাক্ষর ছিল মৃণাল সেনের। সত্যজিৎ রায়ও ছবিটি মুক্তির পক্ষে কথা বলেছিলেন। তিনি ছবিতে আপত্তিকর কিছু আছে বলে মনে করেননি। ছবিটি মুক্তির জন্য ঋত্বিক ঘটক স্বয়ং দেখা করেন ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে।

নানা বাধা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত ছবিটি মুক্তি পায়। আর এজন্য সিনেমাপ্রেমীরা এবং ঋত্বিক ঘটকের ভক্তরা ধন্যবাদ জানাতে পারেন ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পিএন হাকসারকে। ছবিটিকে ছাড়পত্র দিতে হাকসারই ইন্দিরা গান্ধীকে রাজি করিয়েছিলেন।

আমার লেনিনের ছাড়পত্রের এসব অজানা তথ্য জানা যায় ভারতের সাবেক মন্ত্রী জয়রাম রমেশের বই ইন্টার্টওয়াইন্ড লাইভস : পিএন হাকসার অ্যান্ড ইন্দিরা গান্ধী থেকে। বইতে জয়রাম রমেশ প্রভাবশালী ভারতীয় আমলা হাকসারের জীবনী তুলে ধরেছেন।

আর্কাইভে থাকা দাপ্তরিক দলিলপত্র, মেমো, নোট ও চিঠি ঘেঁটে জয়রাম রমেশ হাকসারের জীবনকে তুলে ধরেছেন—১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছেন হাকসার।

যাহোক, ঋত্বিকের আমার লেনিন নিয়ে জয়রাম রমেশ তার বইয়ে লিখেছেন, ‘এ ক্ষ্যাপাটে বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা লেনিনের ওপর একটি ছবি নির্মাণ করেন কিন্তু সেটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়।’

১৯৭১ সালের ৬ জানুয়ারি পিএন হাকসার ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ঋত্বিকের আমার লেনিনের কথাটি তোলেন। সেদিন পিএন হাকসার এ বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে যা বলেছিলেন, সে কথাগুলো এ রকম—সারা দুনিয়ার বহু প্রজন্ম আইজেনস্টাইন, পডোভকিন, রোজেলিনি ও আরো অনেক পরিচালকের জ্বালাময়ী অনেক ছবি দেখেছে। এসব ছবি একেবারে গণপ্রদর্শনী হয়েছে। কিন্তু কোথাও প্রতিক্রিয়ায় তেমন কিছু ঘটেনি। ছবিগুলো বাণিজ্যিক ক্যাটাগরিতে সার্টিফায়েড হলেও সেগুলো সিনেমাহলে খুব বেশি দেখানো হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। আমার লেনিন ছবিটি আমি দেখেছি। এটুকু বলতে পারি, ঋত্বিক ঘটকের এ ছবি বিপ্লবকে এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ আগে এনে দিতে পারবে।

হাকসার বরং মনোযোগ দিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটকের দারিদ্র্যের দিকে। ‘কিছু দুর্ভাগা ফাইন্যান্সারের কাছ থেকে সামান্য অর্থ নিয়ে ছবিটি নির্মিত হয়েছে এবং এখন ঋত্বিক ও প্রযোজকরা যে কোনো মূল্যে ছবিটি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে বিক্রি করতে চান।’

এরপর হাকসার কিছুটা হাস্যরসের সঙ্গে বলেন, ‘ভারতীয় লেনিনকে সোভিয়েত ইউনিয়নে রফতানি করাটা মজার ব্যাপারই হবে! আমি আশা করি সোভিয়েত সমাজ এটা সহ্য করে নেবে। আমার বরং এ ব্যাপারটা কৌতুক মনে হচ্ছে যে কীভাবে কর্মকর্তারা ছবিটি মুক্তি দেয়া হবে নাকি হবে না সে বিষয়ে আলোচনা করে দাপ্তরিক সময়ের বেশ কয়েক ঘণ্টা নষ্ট করেছে।’ এসব বলে হাকসার ইন্দিরা গান্ধীকে পরামর্শ দেন আমার লেনিনকে ‘এ’ ক্যাটাগরির সেন্সর সার্টিফিকেট দিয়ে দিতে।

কিন্তু তখন হাকসারের মনে হলো তিনি তার উদারতা থেকে একটু বেশিই বলে ফেলেছেন। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি তখন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন যে তিনি (ইন্দিরা) চাইলে ছবিটিতে থাকা জমি দখলসংক্রান্ত একটি অংশের বিবরণীটি বাদ দিয়ে ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ বলে ছাড়পত্র দিতে সম্মতি দিতে পারেন। ইন্দিরা গান্ধী এ পর্যায়ে এসে রাজি হয়ে গেলেন!

পিএন হাকসার পড়াশোনা করেছিলেন বিজ্ঞান বিভাগে, প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন আইনে, পেশায় ছিলেন কূটনৈতিক আর চিন্তায় কমিউনিস্ট থেকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী।

আমার লেনিন প্রযোজনা করেছিল সুমনা ফিল্মস, প্রযোজক সুশীল করণ, সিনেমাটোগ্রাফিতে ছিলেন ধ্রুব কুমার বসু ও শক্তি ব্যানার্জি। তথ্যচিত্রে সংগীত পরিচালনা করে প্রশংসিত হয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। অভিনয় করেছিলেন অরুণ কুমারসহ আরো অনেকে। আর অতি অবশ্যই পরিচালনা ও চিত্রনাট্য ঋত্বিক ঘটকের।

 

আউটলুক ম্যাগাজিন ও গণশক্তি পত্রিকা অবলম্বনে শানজিদ অর্ণব

এমন আরো সংবাদ

Back to top button