শিবগঞ্জের পরিমল বানুর মুখে হাসি
‘ভাঙা ঘরের বেড়ার ভেতর দিয়ে কুকুর ঢুকেছে। ঘরে থাকা খাবার খেয়ে গেছে। সারা দিন খেতে পই পই করে ছুটে এসে ঘরে খেতেও পারিনি।’ বলতে বলতে ঝাপসা হয়ে যায় পরিমল বানুর চোখ। গায়ে জড়ানোর ওড়নার কোনায় চোখ মোছেন।
তবে এখনকার পরিমল বানুর মুখে আছে সফলতার হাসি। অতীতের পরিশ্রম-কষ্টকে পুঁজি করে দেশের কৃষি খাতে তিনি নিয়ে এসেছেন আধুনিক কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের উত্তরণ। নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে তিনি এখন একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার জানগ্রামে বাড়ি পরিমল বানুর। কিশোরী বয়সে বধূ হয়ে এসেছিলেন মোসলেম মণ্ডলের ঘরে। বাবার ঘরে দুই বিয়ে থাকায় অশান্তি ছিল। কিন্তু নিজের সংসার পেয়ে ছোট ছোট পায়ে শান্তি খুঁজতে শুরু করেছিলেন। সংসারে টানাপোড়েন থাকলেও স্বামী নিজের ট্রাক্টর চালিয়ে, জমি চষে আর ঘরের সঙ্গে বসানো চালের মিল চালিয়ে দিব্যি চলছিল সংসার। কিন্তু সেই সামান্য সুখও বেশি দিন কপালে থাকেনি পরিমল বানুর। জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন মোখলেস মণ্ডল। পরিমল বানুর কোলে রেখে গেলেন দুই ছেলে আর দুই মেয়ে। সবাই প্রায় পিঠাপিঠি। স্বামী হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে খড়কুটোর মতো ভাসতে লাগলেন পরিমল বানু।
২০০৪ সালে সেই সময়ে স্বামীর পুরোনো ট্রাক্টর চালিয়ে কিছু মাস কাটলেও ধারের দেনা-পাওনার মারপ্যাঁচে জড়িয়ে সেটাও হাতছাড়া হয়ে যায়। ঋণে কেনা গাড়ির টাকা পরিশোধ না করতে পারার জন্য সেটাও ধরে রাখতে পারছিলেন না পরিমল বানু। বড় ছেলে সাগরকে এ সময় দুবাইতে পাঠান কাজে। পরিবারের দিকে তাকিয়ে কিশোর সাগর পাড়ি জমান কষ্টের সেই পথে। এদিকে কোলে তখন ৭ বছর বয়সের আলামিন আর ৪ বছরের ছোট মেয়ে শান্তনা আক্তার ।
আলামিন ছোট হলেও সেই সময়ে পরিবারের হাল ধরা শুরু করেন। পুরোনো ট্রাক্টর নিয়েই ছোট্ট আলামিন মাঠে যেতেন। কিন্তু সে অর্থেও যেন সংসার অচল। সঙ্গে আছে সেই ট্রাক্টরটিরও ঋণ। সব ভেবে পরিমল বানু সেটিও বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিক্রির টাকা দিয়ে ধার-দেনা শোধ করে বছর ঘুরতেই ২০০৬ সালে স্থানীয় কৃষি অফিসে আবার নতুন ট্রাক্টরের জন্য আবেদন করেন তিনি। নতুন ট্রাক্টর পেয়ে একটু একটু করে আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখতে শুরু করেন তিনি।
তবুও বাধা ছিল নানা রকম। শুরুতে সাধারণ কৃষকেরা কাজের জন্য এমন আধুনিক কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করতে চাইতেন না। কিন্তু যখন তাঁরা বুঝতে পারলেন যে মেটালের এই ট্যাফে ট্রাক্টর ব্যবহার করে কম সময়ে জমি চাষাবাদ করা যায়, তখন তাঁরাও আগ্রহী হয়ে ওঠেন এই যন্ত্রে। নিজের জমির সঙ্গে সঙ্গে পরিমল বানু গ্রামের আরও কৃষকদের জমি চাষ করতে শুরু করেন। পরিমল বানুর ট্রাক্টর শিবগঞ্জের মাটি পেরিয়ে চষতে শুরু করে টাঙ্গাইল, নাটোর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়ার জমি। দূর-দূরান্তের কৃষি পেশার মানুষ কৃষিতে এমন আধুনিক যন্ত্রাংশের ব্যবহার নিয়ে জানতে পরামর্শ নিতে আসেন পরিমল বানুর পরিবারের কাছে।
সাগর মায়ের এই উদ্যোগের কথা জানতে পেরে দেশে ফিরে আসেন। সহযোগী হন মায়ের এই ঘুরে দাঁড়ানোর সময়ের। প্রতি দুই বছর পরপর পুরোনো মডেলের ট্রাক্টর বিক্রি করে নতুন ট্রাক্টর কিনেছেন তাঁরা। আশপাশের গ্রামের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন আধুনিক কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে। ধীরে ধীরে পরিবারে সচ্ছলতা এনেছেন পরিমল বানু। বিয়ে দিয়েছেন তিন ছেলেমেয়ের। ছোট মেয়ে স্নাতক করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কুঁড়েঘরের বদলে এখন হয়েছে ইটের ঘর, নিজের চাষের কিছু জমি, গোয়ালে দুধেল গরু আর জমির ফসলে ভরেছে বাড়ির উঠান। গত ১৫ বছরে এ পর্যন্ত মেটালের আইশার ও ট্যাফে ব্র্যান্ডের মোট ১৪টি ট্রাক্টর কিনেছেন পরিমল বানু। সঙ্গে নিয়েছেন ২টি কম্বাইন হার্ভেস্টার। ইতিমধ্যে আরও একটি হার্ভেস্টারের জন্য আবেদন করেছেন তিনি।
নিজের সেই অসহায় সময়ের কথা এখনো ভোলেননি পরিমল বানু। কিন্তু মেটালের ট্রাক্টরের মতো আধুনিক কৃষিযন্ত্রই যেন তাঁকে নিয়ে গেছে সফলতার শিখরে। আগামী দিনে দেশের আরও অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে যেতে চান তিনি। কৃষি পেশায় যেন এমন আধুনিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে আরও মানুষ উপকৃত হয়, তাঁর মতো যেন আরও মানুষ নিজেদের ভাগ্য বদলে নিতে পারেন, সেটারই স্বপ্ন দেখেন পরিমল বানু। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, সময়ের চেয়ে যারা এগিয়ে থাকে, সাফল্য তাদের হাতেই ধরা দেয়। আর সেরা প্রযুক্তির ওপর যারা ভরসা রাখে, কৃষিকাজে তারাই হয় সমৃদ্ধ আগামীর সেরা কারিগর। সেই কৃষি ও কৃষকের উত্তরণের সঙ্গে মিশে থাকবে মেটাল।