দুই দশক আগেও দেশের জনশক্তি রফতানি খাত ছিল মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর। একপর্যায়ে জনশক্তি রফতানির অন্যতম প্রধান গন্তব্য হয়ে ওঠে মালয়েশিয়াও। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দা, বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক সংকট, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও কূটনৈতিক সংকটসহ নানা কারণেই জনশক্তির এসব বাজার এখন ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ অবস্থায় নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক প্রবাহ ধরে রাখতে জনশক্তি রফতানি খাতে দ্রুত বিকল্প গন্তব্য খুঁজে বের করার বিকল্প নেই বাংলাদেশের। সেক্ষেত্রে জনশক্তি রফতানিতে সম্ভাবনাময় নতুন বাজার হয়ে উঠতে পারে ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার কম জন্মহারযুক্ত দেশগুলোই।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কর্মীর চাহিদা কমে আসছিল কয়েক বছর ধরেই। এ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে চলমান করোনা মহামারী। বেশ কয়েক বছর ধরেই নতুন শ্রমবাজারের অনুসন্ধান করছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এজন্য কম জন্মহার ও ক্রমহ্রাসমান কর্মক্ষম জনশক্তির ৫৩টি দেশে শ্রমবাজার অনুসন্ধানের কার্যক্রম চালানো হয়, যার ধারাবাহিকতায় এরই মধ্যে সেশেলস ও মরিশাসে জনশক্তি পাঠানোর কাজ শুরু হয়েছে। দ্রুত বিকল্প শ্রমবাজার তৈরির লক্ষ্যে পোল্যান্ড, আলজেরিয়া ও জাপানে যোগাযোগ বাড়িয়েছে মন্ত্রণালয়। কূটনৈতিক তত্পরতা চলছে এসব দেশের শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্তির জন্য। নতুন শ্রমবাজার হিসেবে ইউরোপের কয়েকটি দেশ থেকেও সাড়া পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যেসব দেশে জন্মহার কম হওয়ায় সামনের দিনগুলোয় কর্মক্ষম জনশক্তি হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেগুলোতেই শ্রমবাজারের সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় রেমিট্যান্সের প্রবাহ বজায় রাখতে জনশক্তি রফতানির নতুন বাজার খুঁজে বের করার পরামর্শ দেয়া হয়। প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জনশক্তি রফতানি খাতের ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণে কয়েকটি ভিন্ন দৃশ্যপট তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে প্রথমটিতে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় (দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, জাপান ইত্যাদি) অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে, যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। ২০২৭ সাল নাগাদ এসব দেশে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে আগত অভিবাসী শ্রমিকের হার বাড়বে ১২ শতাংশ হারে। সে হিসেবে ওই সময় পর্যন্ত পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় নতুন অভিবাসী কর্মী প্রবেশ করবে ১ লাখ ৯৬ হাজার।
এ সময় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ও শ্রীলংকা থেকে অভিবাসী আগমন বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ২৩ শতাংশে। অন্যদিকে মোট প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশী ও ভারতীয় শ্রমিকদের অবদান দাঁড়াবে অর্ধেকেরও বেশিতে।
‘টুওয়ার্ডস সেফার অ্যান্ড মোর প্রডাক্টিভ মাইগ্রেশন ফর সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে দ্বিতীয় দৃশ্যপট তুলে ধরে বলা হয়, ২০২৭ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় অভিবাসী গমনের হার কমবে ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে দক্ষিণ থেকে অভিবাসী পূর্ব এশিয়ায় শ্রমিক আগমনের হার বাড়বে ২১ শতাংশ হারে।
শ্রমবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনি বলেন, আমাদের বিদ্যমান প্রধান শ্রমবাজারগুলোয় চাহিদা কমেছে। সৌদি আরব করছে সৌদীকরণ, কাতার করছে কাতারকরণ। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের ওই সব দেশ তাদের নিজেদের নাগরিকদের কর্মসংস্থানে জোর দিচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের নতুন শ্রমবাজারের বিকল্প নেই। কেয়ারগিভার বাংলাদেশী কর্মীদের জাপান, জার্মানি ও থাইল্যান্ডে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে থাইল্যান্ড থেকে কেয়ারগিভার হিসেবে কর্মীর চাহিদাপত্র এসেছে।
তিনি বলেন, নতুন শ্রমবাজার হিসেবে জাপান, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের বেশকিছু গন্তব্য যেমন উজবেকিস্তান, ক্রোয়েশিয়া ও পোল্যান্ডকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে উজবেকিস্তান থেকে বেশকিছু চাহিদাও এসেছে। তবে এসব ক্ষেত্রে বেশ সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। কারণ অনেক দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে নেই। ফলে ভিসা প্রসেসিংসহ অন্যান্য কাজে ব্যয় বাড়ে। আমরা ওই সব দেশে যোগাযোগ করছি যাতে বাংলাদেশে ভিসা সেন্টার চালু করে। এটা করা গেলে ওই সব দেশে অভিবাসন খরচ কমিয়ে আনা যাবে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিকল্প শ্রমবাজার হিসেবে ছয়টি নতুন দেশে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগের ঘোষণা এসেছে। দেশগুলো হলো কম্বোডিয়া, পোল্যান্ড, চীন, রুমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও সেশেলস। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, বিদেশে বাংলাদেশী শ্রমিকদের শ্রমবাজার যাতে সংকুচিত না হয়, সেজন্য বাংলাদেশী মিশনগুলো নিরলসভাবে কাজ করছে। নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধানের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও জোরেশোরে চলছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আনুমানিক হিসাব দেখিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭-২০২৩ সালের মধ্যে এসব দেশে উল্লেখযোগ্য হারে অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, যার ধারাবাহিকতায় প্রায় ৪ কোটি ৪০ লাখ অদক্ষ শ্রমিককে সরিয়ে সেখানে দক্ষ শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়া হবে।
তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী কর্মীদের ৬২ শতাংশ আধা দক্ষ কিংবা অদক্ষ। ৩৪ শতাংশকে দক্ষ বলা হলেও তারা কতটা প্রশিক্ষিত তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। দক্ষতার অভাবে বিদেশে ভালো কাজ পান না বাংলাদেশীরা। অন্যান্য দেশের কর্মীদের তুলনায় কম বেতন পান।
তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, বর্তমানে প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ৭১টি নতুন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শুধু দেশেই নয়, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী নাগরিকদেরও প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে গ্রিসে প্রাথমিকভাবে এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিগগিরই বাহরাইন ও সৌদি আরবে চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশী কর্মী অধ্যুষিত সব দেশেই প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন জানান, এ মুহূর্তে মানসম্মত অভিবাসনের দিকে জোর দেয়া হচ্ছে। এতদিন যেসব দেশে কর্মীরা যাচ্ছিলেন সেখানে অদক্ষদের পাঠানো যেত। অল্প বেতনেই নেয়া যায় তাই দেশগুলোও অদক্ষদের নিত। আবার যেকোনো সময় কাজ থেকে বাদ পড়ার ঝুঁকিও বেশি অদক্ষদের। এ কারণে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দক্ষতা বাড়ানোতে ফোকাস দেয়া হয়েছে। যাতে রেমিট্যান্স আরো বেশি আসে। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশে দক্ষ কর্মী তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে যারা কাজ করছেন, তাদেরও দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জন্য দূতাবাসগুলোর সহায়তা নেয়া হচ্ছে।