শ্রম রফতানি খাতে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা
কোনো বিষয়ে নেই বিশেষ দক্ষতা। কোনো কাজের প্রশিক্ষণও নেয়া হয়নি কখনো। এমনকি বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাও জানা নেই। এতসব না থাকার মধ্যেও একবার কাঙ্ক্ষিত দেশে যেতে পারলেই মিলবে সব সমাধান। দেশের বিপুলসংখ্যক বেকার যুবকদের এমন স্বপ্নই দেখায় অসাধু আদম ব্যবসায়ী বা মধ্যস্বত্বভোগীরাও। আর তাদের ফাঁদে পড়ে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়েই বিভিন্ন দেশে গিয়ে অবৈধ হয়ে পড়ছেন অনেক বাংলাদেশী। এমনকি ভূমধ্যসাগরের বিপত্সংকুল পথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দিকে ছুটতেও পিছপা হচ্ছেন না তারা। এতে সাগরে ডুবেই মৃত্যুর ঘটনা যেমন ঘটে, তেমনি তীরে পৌঁছে অভিবাসন পুলিশের কাছে আটক হওয়ার সংখ্যাও কম নয়।
অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার এ প্রবণতা বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ব্র্যান্ডিং তৈরি করছে বহির্বিশ্বে, যা ঝুঁকিতে ফেলছে দেশের শ্রম রফতানি খাতকে। আর এসব হচ্ছে মূলত অসাধু মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই।
মধ্যস্বত্বভোগী ও দালালদের দৌরাত্ম্যে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ধারাবাহিকভাবে চিঠি আসছে দূতাবাসগুলো থেকে। সম্প্রতি ব্রুনাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হোসেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট একাধিক মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে চিঠি দেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কয়েকজন বাংলাদেশী দালাল ও স্থানীয়দের যোগসাজশে গড়ে ওঠা অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে ব্রুনাইয়ে শ্রমবাজার বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিসা ব্যবসায়ী চক্র হাইকমিশনের ভিসা সত্যায়ন ছাড়াই কথিত বডি কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশীদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করছে। ব্রুনাইয়ে নিয়ে আসার পর এসব কর্মীকে প্রতিশ্রুত কাজ না দিয়ে মানব পাচার, মাদকদ্রব্য বহন, পতিতাবৃত্তি ও চীনা কোম্পানির পেটোয়া বাহিনীর মতো কাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য করা হয়। এ অপরাধী চক্রের তত্পরতা বন্ধ করা না গেলে মালয়েশিয়ার মতো ব্রুনাইয়েও বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে।
বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এমনকি কম্বোডিয়ায়ও। সম্প্রতি ভিয়েতনাম থেকে শূন্য হাতে ফিরে আসনে ১০৬ জন বাংলাদেশী। প্রতারণার পাশাপাশি নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন তাদের কেউ কেউ। তাদের প্রত্যেককেই মাসে ৫০০ ডলারের বেশি আয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে কর্মসংস্থানের আশায় গিয়ে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে ছয়-সাত মাস পরই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
অভিবাসনপ্রত্যাশীরা প্রতারিত হচ্ছেন সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবে গিয়েও। নির্যাতন-নিগ্রহের শিকার হয়ে প্রতিনিয়তই ফিরে আসছেন শ্রমিকরা। অথচ দালাল-মধ্যস্বত্বভোগীদের ফাঁদে পড়ে এখনো সৌদি আরবে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন অনেক বাংলাদেশী। কাজ না থাকার পরও উচ্চবেতনে কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিনিয়তই হাজার হাজার বাংলাদেশীকে নিয়ে যাচ্ছে দালালরা। কফিল ও ইকামাবিহীন এসব বাংলাদেশী শ্রমিকের পরবাসে দিন কাটছে অনাহার-দুশ্চিন্তা আর গ্রেফতারের ভয়ে। গত ছয় মাসেই দেশটি থেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ শেষে ও কাজ হারিয়ে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন ৪০ হাজার ৪৯৪ জন। মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রেও একই প্রলোভন দেখিয়ে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। লোভে পড়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে দেশটিতে গিয়ে দেখছেন কোনো কাজ নেই। শেষে অবৈধ হয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা প্রচার-প্রচারণা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে এভাবে দেশ ছাড়ার পেছনে মূলত বিদেশের প্রতি মোহই দায়ী। এখনো অনেকের বিশ্বাস, সেখানে গেলেই উচ্চবেতনে কাজ পাওয়া যাবে। অথচ সেখানে গিয়ে তারা কী করবেন, সে বিষয়ে তাদের নিম্নতম কোনো ধারণা নেই। সরল বিশ্বাসে দালালদের মাধ্যমে সেখানে যাচ্ছেন তারা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কম্বোডিয়ায় বেশকিছু বাংলাদেশী নাগরিক মালয়েশিয়ান এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকদের সঙ্গে যৌথ প্রতিষ্ঠান খুলেছে, যারা দেশে অবস্থানরত দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে প্রতারণা করছে। অভিবাসনে ইচ্ছুকদের স্টিকার ভিসায় কম্বোডিয়ায় নিয়ে মানবেতর অনিশ্চিত জীবনযাপনে বাধ্য করছে। আবার অনেক শিক্ষিত যুবককে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে ট্রানজিট দেশ হিসেবে কম্বোডিয়ায় নিয়ে ফেলে রাখছে, যারা পরে অবৈধ হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে পর্যটনে গতি আনতে বাংলাদেশীদের অন-অ্যারাইভাল ভিসার সুবিধা দিচ্ছে ইন্দোনেশিয়া। এটিকেও পুঁজি করে গড়ে উঠছে মানব পাচারকারীদের নিরাপদ রুট। ঢাকা থেকে ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছার পরই তাদের মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায়, অনেককে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার প্রলোভনও দেখানো হয়।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, অসাধু দালালদের রুখতে বিভিন্ন সময়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। যাদের সম্পর্কে অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাদের পাসপোর্ট অবিলম্বে বাতিল করে তাদের আইনের আওতায় আনা হয়। পাশাপাশি হাইকমিশন থেকে ভিসা সত্যায়ন ছাড়া বডি কন্ট্রাক্টের নামে যেন কেউ যেতে না পারে সেজন্য বিমানবন্দরগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে।
জানা গেছে, ইউরোপে পৌঁছে দিতে তুরস্ককেও ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। তুরস্কে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানব পাচারকারীরা ইউরোপে পাঠাতে বাংলাদেশীদের ইলেকট্রনিকস ভিসায় প্রথমে জর্জিয়া পাঠায়। এরপর তাদের তুরস্ক হয়ে ইউরোপের অন্য কোনো দেশে পাঠানোর জোর চেষ্টা চালায়। বিকল্প হিসেবে অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ২০ লাখেরও বেশি মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশী রয়েছেন ১৯ হাজারেরও বেশি। যেসব দেশের নাগরিকদের মধ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অনুপ্রবেশের প্রবণতা দেখা যায়, সেসব দেশের তালিকায় শীর্ষ দশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ, অবৈধ ও বিপত্সংকুল পথ পাড়ি দিতে গিয়ে এখন পর্যন্ত অনেক বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের ৯ মে তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে মৃত্যু হয় ৩৭ বাংলাদেশীর। ইউরোপে অভিবাসনের আশায় অবৈধ পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছিলেন তারা।
এছাড়া প্রায়ই অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে স্থানীয় উপকূলরক্ষী বা কর্তৃপক্ষের হাতে আটক হচ্ছেন অনেক বাংলাদেশী। আর্থিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনের লোভ দেখিয়ে তাদের সবাইকেই বিপত্সংকুল এ পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মানব পাচারকারীরা। এজন্য ঋণ ও ভিটেমাটি বিক্রি করে পাওয়া টাকা মানব পাচারকারী ও দালালদের হাতে তুলে দিতে হয়েছে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের।
ইইউভুক্ত দেশগুলো বর্তমানে অবৈধ অভিবাসন নিয়ে বেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। অবৈধ অভিবাসীদের ইউরোপ থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাষ্ট্রজোটটির সদস্য দেশগুলো। এক্ষেত্রে যেসব দেশ তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করবে, সেসব দেশের নাগরিকদের জন্য ইইউর ভিসা সীমিত করে দেয়া হবে। ২০১৪ সাল থেকে অভিবাসীদের নিয়ে এ কঠোর অবস্থানে রয়েছে ইইউ। দীর্ঘ সময় ধরে অনুপ্রবেশকারীরা প্রধানত মানব পাচারকারীদের মাধ্যমে সেখানে প্রবেশ করেছে। তাদের বেশির ভাগই সমুদ্রপথে ইতালি হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এ পথে আসাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশ ও নাইজেরিয়ার নাগরিক। অবৈধ মানব পাচার ঠেকাতে বর্তমানে পথটি বন্ধ করে দিয়েছে ইইউ।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্যমতে, সাগরপথে ইউরোপে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাতে গিয়ে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) আটক হয়েছেন ৬৩৯ বাংলাদেশী। সংস্থাটি জানায়, অবৈধভাবে সাগরপথে ইউরোপে পাড়ি জমানোর প্রবণতা দেশের ৮-১০টি জেলার মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। মূলত শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা। অনেক ক্ষেত্রে জেনেশুনেই এসব জেলার অভিবাসনপ্রত্যাশীরা এ মরিয়া প্রয়াসের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান এ বিষয় বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ফেরত আসা মানুষের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি মধ্যস্বত্বভোগী দালালরাই এর জন্য দায়ী। কারণ অবৈধ পথে বিদেশে যেতে যেসব ঝুঁকি আছে তার তথ্য মধ্যস্বত্বভোগীরা গোপন রাখে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের শুধু সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নই দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে গিয়ে তারা দেখেন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের দেশের অভিবাসন প্রক্রিয়া পুরোটাই দালালনির্ভর। বিদেশে যাওয়ার কর্মীর বেশির ভাগই তার রিক্রুটিং এজেন্সির নাম-পরিচয় সম্পর্কে অবগত থাকেন না। ফলে সহজেই প্রতারিত হন। সরকারকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে অভিবাসন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগী রাখা হবে কিনা। যদি রাখা হয় তবে অবশ্যই মধ্যস্বত্বভোগীদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে।