মতামত
নারী নির্যাতন উৎস অনুসন্ধান

বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহনে সবার অংশ গ্রহনের নিশ্চয়তা বিধান করেছিলেন কেবল নারী ও কৃতদাস ছাড়া । ফ্রেঞ্চ রেভলুশন ১৭৮৯ সালে রাজতন্ত্র ও গীরযাতন্ত্রকে অপসারণ করে মানুষের সার্বভৌমত্ত ঘোষণা করেছিলো । কিন্তু ঘোষনা হয় ‘ all men are created equal ” । ফ্রান্সে নারীরা ভোট দেওয়ার অধিকার পায় ১৯৪৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪ বছর পর । ১৭৭৬ সালে বিজয়ের পর মারকীন সংবিধানে বলা হয়েছিল সবাই সমান কেবল নারী ও ক্রীতদাস ছাড়া । ইউরোপের এনলাইটেন্মেন্ট , ফ্রেঞ্চ রেভ্লুশন , মার্কিন রেভ্লুশন সভ্যতাকে অগ্রসর করেছে কিন্তু নারীমুক্তি আসেনি । নারীমুক্তি অর্থাৎ মানবমুক্তির আশা সঞ্চার করেছিল ১৯১৭ সালে রূশ বিপ্লব । নারীর ভোটাধিকার , সিদ্ধান্ত গ্রহনে নারীর অংশগ্রহন ঘোষিত হয়েছিলো ।
পৃথিবীব্যাপী পুঁজিবাদী রাজনীতি, অর্থনীতি , সংস্কৃতি বৈষম্য-কেন্দ্রিক এক অসম ব্যাবস্থা সৃষ্টি করেছে । দারিদ্র ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় এশিয়া আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকায় ব্যাপকভাবে নারীরা নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে । মুনাফা কেন্দ্রিক রাজনীতি-বাণিজ্য নারীকে পন্যে পরিনত করেছে ।
সারা পৃথিবীব্যাপী এবং বাংলাদেশে নারীকে ধর্ষণ এবং হত্যা কেবল ‘টিপ অফ দ্যা আইসবার্গ ‘ । সমাজ সংসারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে যায় নারী নির্যাতনের হাজারো অজানা কাহিনী । বলপ্রয়োগের নিষ্ঠুর কাঠামোকে ভিত্তি করে রাস্ট্রের রাজনীতি অর্থনীতির যে বুনিয়াদ গড়ে ওঠে ,নির্যাতনের মনস্তত্ত গড়ে ওঠে সেখান থেকেই । বলপ্রয়োগে খমতা দখল , ভোটকেন্দ্র দখল , ভুমীদখল, নদী দখল , খাল , বিল , জলাশয় ,বনভুমি দখল , কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয় , ক্যাম্পাস দখল আর বলপ্রয়োগে নারীর শরীর দখল একই সুত্রে গাঁথা । আইনহীনতার সংস্ক্রিতিকে ভিত্তি করে যে পুরুষ নির্যাতক হয়ে ওঠে তা দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি । কেবল কয়েকজন ধর্ষককে শাস্তি দিলেই নির্যাতক মানব প্রেমিক হয়ে উঠবে না । দৃষ্টি দিতে হবে নির্যাতনের সংস্কৃতির দিকে ।
নির্যাতন বা এবিউজ কেবল শারীরিক হতে পারে তাই না । হতে পারে মৌখিক । ফিজিক্যাল এবিউজ , সেক্সচুয়াল এবিউজ ও ভারভাল এবিউজ । বাংলাদেশে এই সকল এবিউজ প্রক্রিয়া শুরু হয় পারিবারিক , সামাজিক ও প্রাথমিক শিক্ষাক্রম থেকে । ‘ মাইরের উপর ঔষধ নাই ‘ কিংবা ‘দুই ঘা দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে’ , সমাজে, স্কুলে এবং গৃহে এই সকল অমানবিক প্রক্রিয়ায় আগামীদিনের নির্যাতক মানসিকতা তৈরী হয় । যে সন্তান শিক্ষক কত্রিক বা পরিবারের কারো দারা নির্যাতনের শিকার হয় সে সন্তানের মানসিক গঠন স্বাভাবিক হয় না । সমাজ রাস্ট্রের খমতায় টিকে থাকার ভিত্তি যদি হয় বলপ্রয়োগ ,আচরন গত সংস্কৃতিতে যদি যুক্ত হয় আঘাত করার মানসিকতা সেই সমাজ নির্যাতকের ব্রিডিং গ্রাউন্ড ।
আচরণগত সংস্কৃতি সংস্কৃতির সর্বচ্চ রুপ । ধাপ্পাবাজি , অন্যকে ঠকানো , প্রতারণা , বিশ্বাসহীনতা , বাগাড়ম্বর, সাম্প্রদায়িক মনোভাব , অপরকে হ্যারাস করা , এম্বারাস করা , মিত্থা কথা বলা ও অন্যের প্রতি বিবেচনাহীনতা আমাদের জাতীও সংস্কৃতিতে রুপ পেয়েছে । এমন বাস্তবতায় রাস্ট্র নিজেই নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ।
ধর্মকে ব্যাবহার করে ধর্মভিত্তিক প্রচার প্রচারণায় নারীকে অসন্মান করে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে বহু বছর ধরে । নারীকে ”তেতুল” , ‘বৈদ্যুতিক তার ” , কলা ইত্যাদি নিম্নমানের উপমায় অপমান করা হচ্ছে , শাসক শ্রেণীর নাকের ডগায় এমনকি তত্ত্বাবধানে এস হচ্ছে । ক্ষমতায় থাকার রাজনীতিতে এদেরকে ব্যাবহার করা হচ্ছে । নারীর প্রতি অসন্মান , বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম থেকে শহরে । নারীর প্রতি বলপ্রয়োগের মানসিকতা জন্ম নিচ্ছে ।
এই পৃথিবীতে নারীকে ছাড়া কোন সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব না । নারীকে নির্যাতনের মুখে ঠেলে দিয়ে কোন জাতীও উন্নয়ন সম্ভব না । নারীর মুক্তি জাতীর মুক্তি । নারীর মুক্তি মানব মুক্তি । নারীর উপর নির্যাতন সমগ্র জাতীর উপর নির্যাতন ।
আমাদের অর্থনীতির চাকা কারা সচল রেখেছে ? ৮০ শতাংশ রপ্তানি বাণিজ্য কাদের দারা অর্জিত হচ্ছে ? নিম্ন মজুরীর , নিম্ন আয়ের সেই সব নারী শ্রমিক যাদের শোষণ করে উদ্বৃত্ত মুল্য লুন্ঠন করছে কিছু ব্যাবসায়ী ,রাজনীতিবিদ । স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদান আমরা ভুলে গেছি ? ” এদেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত ” ? দুই লক্ষ অস্রুনদী ?