সংকুচিত হয়ে উঠছে বৈদেশিক শ্রমবাজার
দীর্ঘ সময় ধরে কর্মী রফতানি বন্ধ রয়েছে মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই)। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে প্রবেশের অনুমতি নেই বাংলাদেশীদের। বড় নির্ভরতার জায়গা সৌদি আরব থেকেও চাকরি হারিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। আবার ফ্লাইট সংকটে ছুটিতে আসা কর্মীদের ফেরত যাওয়া ও সৌদিতে নতুন কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈদেশিক শ্রমবাজার নিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশীদের জন্য ক্রমেই সংকুচিত হয়ে উঠছে বিদ্যমান বৈদেশিক শ্রমবাজারগুলো। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈদেশিক শ্রমবাজারে দক্ষ-অদক্ষ দুই ধরনের কর্মীর চাহিদা রয়েছে। কর্মীর উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, নেপাল, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকার দেশ সুদান। প্রতিযোগী দেশগুলোর তত্পরতার পাশাপাশি কূটনৈতিক কারণেও অনেক দেশ বাংলাদেশী কর্মী নিতে অনীহা দেখাচ্ছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি, কভিড-১৯ সনদে অনিয়মসহ নানা ইস্যু। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকা দেশ নেপাল, ভিয়েতনাম ও শ্রীলংকাকে কর্মী নিয়োগে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারগুলো। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যমান শ্রমবাজার হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
মালয়েশিয়া ও আরব আমিরাতে দীর্ঘদিন ধরে কর্মী রফতানি বন্ধ থাকায় কর্মী রফতানিতে একটি মাত্র দেশ সৌদি আরবের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বিশ্লেষণেও বিষয়টি উঠে এসেছে। বিএমইটির পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর (২০১৯) বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মী গিয়েছিলেন প্রায় সাত লাখ। এর মধ্যে কেবল সৌদি আরবেই গিয়েছিলেন ৩ লাখ ৯৯ হাজার, যা ওই বছরের মোট কর্মী রফতানির ৫৭ শতাংশ। চলতি বছরও বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন ১ লাখ ৮১ হাজার কর্মী। এর মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন প্রায় ১ লাখ ৩৪ হাজার, যা মোট কর্মী রফতানির ৭৪ শতাংশ।
সবচেয়ে বড় নির্ভরতার জায়গা সেই সৌদি আরবই এখন বাংলাদেশী কর্মীদের বিতাড়ন করার হুমকি দিচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ৪০ বছর ধরে দেশটিতে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেয়ার চাপও দিচ্ছে তারা। না হলে নতুন শ্রমিক নেয়ার ক্ষেত্রে একপ্রকার বাধা দেবে দেশটি। সৌদি আরব থেকে গত ছয় মাসে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ শেষে ও কাজ হারিয়ে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন ৪০ হাজার ৪৯৪ জন প্রবাসী বাংলাদেশী। আর করোনাভাইরাসের কারণে ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার আগে অর্থাৎ গত এপ্রিলের আগে ছুটি নিয়ে এসেছিলেন এমন ৫০ হাজারের বেশি সৌদি প্রবাসী কর্মস্থলে যেতে ভোগান্তিতে পড়ছেন। দেশটিতে যেতে নতুন যেসব কর্মী প্রক্রিয়াধীন ছিলেন তাদের পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০০৮ সালে দেশটিতে গিয়েছিলেন সর্বোচ্চ ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন কর্মী। ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর টানা দুই লাখের বেশি করে কর্মী দেশটিতে যান। তবে হঠাৎ করেই নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ২০১২ সালের শেষ থেকে কর্মী নেয়া একরকম বন্ধই করে দেয় ইউএই। বর্তমানে কিছু গৃহকর্মী ছাড়া অন্য কোনো পেশায় ভিসা দিচ্ছে না দেশটি। ২০১৯ সালে ইউএই যান ৩ হাজার ৩১৮ কর্মী। এর আগে ২০১৮ সালে ৩ হাজার ২৩৫, ২০১৭ সালে ৪ হাজার ১৩৫ এবং চলতি বছর যান ৮৫৩ কর্মী।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০ নির্বাচনে বাংলাদেশ দুবাইকে প্রথম দফায় ভোট না দেয়ার প্রভাব পড়ে কর্মী রফতানিতে। ওই নির্বাচনে বাংলাদেশ রাশিয়াকে সমর্থন দেয়। প্যারিসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি তিন দফা চলে এবং আমিরাত রাশিয়াকে পরাজিত করে ওয়ার্ল্ড এক্সপোর ভেনু হিসেবে নির্বাচিত হয়।
জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, নভেল করোনাভাইরাসের মধ্যেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সচেষ্ট রয়েছে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে। এজন্য প্রবাসী কর্মী নিয়োগের বিকল্প নেই তাদের। ধীরে ধীরে কর্মী নিয়োগও শুরু করেছে দেশগুলো। এ অবস্থায় কর্মী রফতানির জন্য জোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে উৎস দেশগুলো। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে শুরুতেই প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে প্রতিবেশী দেশ নেপাল। সফলতার সঙ্গে দেশটি করোনা সংক্রমণ ঠেকিয়ে রেখেছে। ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। ফলে বৈদেশিক শ্রমবাজারের দখল নিতে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে দেশগুলো।
বাংলাদেশীদের জন্য কুয়েতের শ্রমবাজার বন্ধ হয় ২০০৭ সালের শেষ দিকে। ২০১৪ সাল থেকে সীমিত আকারে কর্মী প্রেরণ শুরু হলেও সেটি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। দেশটির শ্রমবাজার দখল করে নিয়েছে শ্রীলংকা, নেপাল, ভারত ও ফিলিপাইন। গত বছর কুয়েতে কর্মী গিয়েছিলেন ১২ হাজার ২৯৯ আর চলতি বছর গিয়েছেন ১ হাজার ৭৪৩ জন। করোনা পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে দেশটির সঙ্গে সরাসরি আকাশপথে যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে। ফলে অন্ধকারে আছেন দেশটি থেকে ছুটিতে আসা কর্মীরাও।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ বাহরাইনে চলতি বছর পাঠানো হয়েছে মাত্র একজন কর্মী। গত বছর দেশটিতে গিয়েছিলেন ১৩৩ জন। আর ২০১৮ সালে গিয়েছিলেন ৮১১ জন। অথচ আগের তিন বছরে (২০১৫-১৭) বাহরাইনে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো সম্ভব হয়েছিল ১ লাখ ১২ হাজার ২০৫ জন কর্মী। একই অবস্থা লেবানন ও মিসরের ক্ষেত্রে। গত বছর দেশ দুটোতে কর্মী পাঠানো হয়েছিল যথাক্রমে ৪ হাজার ৮৬৩ এবং একজন। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কর্মী পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না লিবিয়া, সুদান ও ইরাকে।
মধ্যপ্রাচ্যের পর বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায়ও প্রায় দুই বছর ধরে কর্মী রফতানি বন্ধ রয়েছে। ২০১৭ সালে দেশটিতে যান ৯৯ হাজার ৭৮৭ জন কর্মী। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে যান প্রায় ১ লাখ ৭৬ হাজার। তবে কর্মী রফতানির নামে দুই দেশের মধ্যে গড়ে ওঠে একটি চক্র। বাংলাদেশী ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির গঠিত ওই চক্র হাতিয়ে নেয় কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশী কর্মী নেয়া বন্ধ হয়ে যায়। গত বছর দেশটিতে গেছেন মাত্র ৫৪৫ জন। পুনরায় কর্মী রফতানি শুরু করতে গত বছর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে উচ্চপর্যায়ের একাধিক বৈঠকেও কোনো ফল আসেনি। যদিও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে রয়েছে কর্মীর চাহিদা, যা প্রতিনিয়তই দখলে নিচ্ছেন ভারত, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এমনকি চীনের কর্মীরাও।
জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, কয়েক বছর ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মীর চাহিদা কমে আসছিল। যা বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে আরো জটিল হয়েছে। দেশে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার আগেই সৌদি আরব, কাতার, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শ্রম রফতানির জন্য প্রায় এক লাখ শ্রম ভিসা ইস্যুর প্রক্রিয়ায় ছিল, যার বেশির ভাগই এখন মেয়াদ উত্তীর্ণ। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত নতুন ভিসার আশা নেই। আগামীতে আমাদের দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে নতুন বাজারের খোঁজ করতে হবে।
করোনার কারণে নিয়মিত ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার আগে গত ২১ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে এসেছেন ৬ লাখ ২৪ হাজারের বেশি প্রবাসী। এসেই দেশে আটকা পড়েন তারা। দীর্ঘ সময় দেশে থাকার পর সম্প্রতি তারাও কর্মস্থলে ফেরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ফ্লাইট চালু না হওয়া, চালু হলেও টিকিট সংকটসহ বিভিন্ন কারণে যেতে পারছেন না তারা।
অন্যদিকে করোনার কারণে নিয়মিত ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার পর বিশেষ ব্যবস্থায় গত ছয় মাসে দেশে ফিরে এসেছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৮ জন প্রবাসী বাংলাদেশী। গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের ২৯টি দেশ থেকে ফেরেন তারা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক বলছে, বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে কাজ না থাকা, কাজের বা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া, আকামা বা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় অবৈধ হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে দেশে ফিরেছেন এসব প্রবাসী কর্মী।