অর্থনীতিলিড নিউজ

সংকটে অর্থনীতির মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে রেমিট্যান্স

valo sangbadনভেল করোনাভাইরাসের কারণে কাজ হারিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন প্রবাসীরা। এর পরও কমেনি রেমিট্যান্সের পরিমাণ। উল্টো প্রতি মাসেই হচ্ছে নতুন রেকর্ড। আগের তুলনায় চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ৪৮ শতাংশের বেশি। সেই সুবাদে সেপ্টেম্বর শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩৯ দশমিক ৩১ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৯৩১ কোটি ডলার। এভাবেই দেশের অর্থনীতির  মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। পোশাক খাতের পরই বিদেশী মুদ্রার দ্বিতীয় বৃহৎ উৎস রেমিট্যান্স। পোশাক সর্ববৃহৎ উৎস হলেও  পণ্যটি তৈরিতে ব্যবহূত কাঁচামালের দাম পরিশোধ বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়। আবার বিদেশী মুদ্রার আরেকটি উৎস ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্সের (ওডিএ) অবদানও যৎসামান্য। একই অবস্থা প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহেও। সব মিলিয়ে প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে বিদেশী মুদ্রা রিজার্ভ ও এর কার্যকারিতা অনেক বেশি।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈধ ও অবৈধ বাংলাদেশী প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। এর মধ্যে সৌদি আরবেই রয়েছেন প্রায় ২০ লাখ। বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীরা তাদের আয়ের বড় একটা অংশ দেশে থাকা পরিবারের কাছে পাঠান। আর এ অর্থ কেবল তাদের পরিবারের মৌলিক প্রয়োজন মেটায় তা নয়, নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশের যেসব এলাকা থেকে প্রবাসীরা বেশি প্রবাসে গিয়েছেন সেসব এলাকার জীবনযাত্রার পরিবর্তন দেখলেই বিষয়টি বোঝা যায়।

প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের বেশি অংশ ব্যয় হয় দালানকোঠা নির্মাণ, ফ্ল্যাট বা জমি কেনায়। প্রবাসী অধ্যুষিত জেলার মানুষের জীবনযাত্রার মান ও মাথাপিছু ব্যয় করার ক্ষমতাও অন্য জেলার মানুষের চেয়ে বেশি। যার প্রমাণ পাওয়া যায় কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল ও নোয়াখালীতে। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন এসব জেলা থেকেই। সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে রফতানি, বিদেশী বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতা বাবাদ অর্থপ্রবাহের চেয়ে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থপ্রবাহ অর্থনীতির উন্নতি সাধন করছে অনেক গভীর থেকে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের বিদেশী মুদ্রা রিজার্ভ সমৃদ্ধ করার অন্যতম মাধ্যম হলো প্রবাসী আয়। অর্থনীতিতে রিজার্ভের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর রিজার্ভের অন্যতম স্তম্ভ হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এ হিসেবে অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভও হলো রেমিট্যান্স। বাস্তবতা হলো অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের প্রভাব বহুমাত্রিক। ব্যক্তি মানুষ থেকে শুরু করে গোটা আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, বিশেষ করে গ্রামীণ রূপান্তরে বড় ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের অবদান আরো বলিষ্ঠ করা সম্ভব এবং প্রয়োজন।

চলতি বছরে এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা ক্রমেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। দারিদ্র্য হ্রাস, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলতে রেমিট্যান্স প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ অবদান আরো বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে রেমিট্যান্সের অংশ ছিল ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ।

বিদেশী মুদ্রার অন্যতম বড় উৎস রফতানি হলেও রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান বলছে, সর্বশেষ অর্থবছরে তা কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। আবার রফতানির ৮৫ শতাংশই পোশাক পণ্য। আর এ পণ্য তৈরিতে আমদানীকৃত কাঁচামালের দাম পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয় বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ। এ প্রক্রিয়ায় পোশাক রফতানি  বাবদ দেশে আসা অর্থের ৪৪ শতাংশ অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়।

দেশের বিদেশী মুদ্রার অন্যান্য উেসর মধ্যে আছে এফডিএ ও  ওডিএ। বর্তমানে ওডিএ দেশের মোট জিডিপির ২ শতাংশের বেশি না। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত এফডিআই স্টক বা পুঞ্জীভূত বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৮৫ কোটি ডলার। এদিকে বছরপ্রতি এফডিআইয়ের পরিমাণও সামান্য। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রথম এফডিআই প্রবাহ সাড়ে তিনশ কোটি ডলারের ওপরে উঠেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাহ আরো কমে যাওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কারণ গত অর্থবছরের নয় মাসে এফডিআই প্রবাহ ছিল ১৭৬ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ৩ জুন দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ছাড়ায়। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ জুন সেই রিজার্ভ আরো বেড়ে ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার অতিক্রম করে। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ৩০ জুন রিজার্ভ ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর ২৮ জুলাই রিজার্ভ ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের ঘরও অতিক্রম করে। তিন সপ্তাহ পর গত ১৭ আগস্ট রিজার্ভ ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়ায়। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ যা ৩ হাজার ৯৩১ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেকর্ড ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান প্রবাসীরা। এরপর আগস্টেও ১৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স ২ বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলারে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসীরা ৬৭১ কোটি ৩১ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৫১ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

বৈধ চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রধান মাধ্যম ব্যাংকিং খাত। সেপ্টেম্বরে দেশের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার।

রেমিট্যান্সের ৩৪ দশমিক ৭২ শতাংশই এসেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে। গত মাসে ব্যাংকটির মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৭৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুব উল আলম বলেন, মহামারীর দুঃসময়ে প্রবাসীরা আগের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়ে আমাদের উৎসাহ জুগিয়েছেন। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকসহ দেশের অনেক ব্যাংকই প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসীদের স্বজনরা হাতে হাতে নগদ অর্থ গ্রহণ করতে পারছেন। আবার মোবাইল ব্যাংকিংসহ প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে রেমিট্যান্সের লেনদেন সহজতর হয়েছে।

শুধু চলতি বছরই নয়, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি কয়েক বছর ধরেই অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ১ হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৪১ কোটি ৯৬ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি ১৬ লাখ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার।

রেমিট্যান্সের বড় প্রবৃদ্ধিতে বাজারে চাহিদার চেয়ে বেশি ডলার জমা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে কয়েক বছর ধরে ডলার বিক্রি করলেও কয়েক মাস ধরে ব্যাংকগুলো থেকে প্রতিনিয়তই ডলার কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ডলার আসায় সরকারের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও উদ্বৃত্তের ধারা ফিরে এসেছে। আগস্ট শেষে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সের রেকর্ড প্রবৃদ্ধিতে উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করলেও করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারীতে আর্থিক বিপর্যয়ে পড়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এক কোটির বেশি বাংলাদেশী। সীমিত পরিসরে ফ্লাইট চালু হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশ থেকে দেশে আসা প্রবাসীদের বড় অংশই কর্মস্থলে ফিরে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন।

দেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরবে নতুন ভিসা বন্ধ। ছুটিতে দেশে ফেরা ৫০ হাজারের বেশি সৌদি প্রবাসী কর্মস্থলে যেতে ভোগান্তিতে পড়ছেন। অনেকের ভিসার মেয়াদও প্রায় শেষ। সৌদি আরবে ফিরে যাওয়ার টিকিট পাওয়া নিয়ে কয়েক দিন ধরেই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও সাউদিয়া এয়ারলাইনসের কার্যালয়ে ভিড় করছেন প্রবাসীরা। টিকিট না পেয়ে বিক্ষোভ দেখিয়ে পুলিশের লাঠিপেটার শিকারও হয়েছেন অনেকে। একইভাবে বিপদে পড়েছেন মালয়েশিয়া থেকে আসা প্রবাসীরাও। করোনার কারণে ফেরার অনুমতি না মেলায় শঙ্কা তৈরি হয়েছে চাকরি হারানোর। বন্ধ রয়েছে কুয়েতগামী সরাসরি ফ্লাইটও। ফেরার টিকিট সংকটে রয়েছেন কাতার, ওমান, সিঙ্গাপুর, ইউএই থেকে ছুটিতে আসা প্রবাসীরাও। উপায় না দেখে সৌদি প্রবাসীদের মতো আন্দোলনে নামার কথাও ভাবছেন অনেকে।

ভালো সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন

এমন আরো সংবাদ

Back to top button