অভিবাসন খাতে কপাল পুড়েছে ৭ লাখ বাংলাদেশির
ঢাকা: করোনা মহামারিতে বিভিন্ন দেশে অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ থাকায় বড় ধাক্কা লেগেছে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বা অভিবাসন খাতে। কপাল পুড়েছে প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশির। এদের কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কেউ ছুটিতে এসে আটকা পড়েছেন আবার কেউ প্রস্তুতি নিয়েও যাওয়ার সুযোগ পাননি। জানা গেছে, গত ছয় মাসে ২৯টি দেশ থেকে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৮ জন, বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরার অপেক্ষায় আছেন আরও প্রায় ২ লাখ। ছুটিতে দেশে এসে আটকা পড়েছেন প্রায় ২ লাখ কর্মী। আর শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়েছেন আরও সাড়ে ৩ লাখ মানুষ। সব মিলিয়ে বলা যায়, এই মুহূর্তে প্রায় ৭ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মহীন রয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরালো করতে হবে। পুনরায় কর্মীদের বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীদের ঋণ প্রাপ্তি ও প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। মন্ত্রণালয় ঘোষিত ৭০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক সূত্রে জানা গেছে, গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৮ জন প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফেরত এসেছেন। তাদের মধ্যে ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৮ জন পুরুষ এবং ১৬ হাজার ৬৪০ জন নারী। বিদেশ ফেরত কর্মীদের মধ্যে বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে কাজ না থাকা, কাজের বা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া, আকামা বা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় অবৈধ হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এসব প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরে এসেছেন। অনেকে আবার বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে আউট পাস নিয়েও দেশে ফেরত এসেছেন। ফেরত আসা কর্মীদের অনেকে আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সংশ্লিষ্ট দেশে ফিরে যেতে পারবেন।
জানা যায়, দেশে ফেরা কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে করোনাভাইরাসের কারণে কাজ না থাকায় সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ফিরেছেন ৪৪ হাজার ৬১৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী ৪১ হাজার ৪৬০ জন। আর নারী কর্মী ফিরেছেন ৩ হাজার ১৫৬ জন। পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন ৩৮ হাজার ১১৫ জন। আউটপাসে এসেছে ৬ হাজার ৫০১ জন।
কাতার থেকে ফিরেছেন ১৪ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১৩ হাজার ৬৭০ জন, আর নারী এক হাজার ২৪১ জন। পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন ১২ হাজার ৯৪১ জন। আউটপাসে এসেছে এক হাজার ৯৭০ জন।
টুরিস্ট নির্ভর দেশ মালদ্বীপ থেকে ফিরেছেন ১০ হাজার ৪৮৩ জন প্রবাসী কর্মী। এরমধ্যে পুরুষ ১০ হাজার ৪১০ জন, আর নারী ৭৩ জন। পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন ৬ হাজার ৭৭৮ জন। আউটপাসে এসেছে ৩ হাজার ৭০৫ জন।
ইরাক থেকে ফিরেছেন ৮ হাজার ৩২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭ হাজার ৯৭২ জন, আর নারী ৬০ জন। পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন ৭ হাজার ৩৮৯ জন। আউটপাসে এসেছে ৬৪৩ জন।
মালয়েশিয়া থেকে ফিরেছেন ৭ হাজার ৫৬৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭ হাজার ২১৬ জন, আর নারী ৩৫২ জন। পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন ৭ হাজার ৪৭ জন। আউটপাসে এসেছে ৫২১ জন।
তুরস্ক থেকে দেশে ফিরেছেন ৬ হাজার ১৪২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫ হাজার ৬৩৬ জন, আর নারী ৫০৬ জন। পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন ৫ হাজার ৮৩৩ জন। আউটপাসে এসেছে ৩০৯ জন।
কাজ না থাকাসহ আউটপাস নিয়ে লেবানন থেকে দেশে ফিরেছেন ৫ হাজার ৮০১ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৩ হাজার ৯১৪ জন, আর নারী এক হাজার ৮৮৭ জন। পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন ২ হাজার ২১১ জন। আউটপাসে এসেছে ৩৫৯০ জন প্রবাসী কর্মী।
সৌদি ফেরত কর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগই বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে আউট পাস নিয়ে এবং কাজ না থাকায় ছুটি নিয়ে দেশে ফিরেছেন। সৌদি আরব থেকে ৩৯ হাজার ১৮৮ জন প্রবাসী কর্মী ফেরত এসেছেন। এর মধ্যে পুরুষ ৩৩ হাজার ৪১২ জন, আর নারী কর্মী রয়েছেন ৫ হাজার ৭৭৬ জন। পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন ৩১ হাজার ১১৬ জন। আউটপাসে এসেছে ৮ হাজার ৭২ জন।
এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারা ভোগ করে আউটপাস নিয়ে ওমান থেকে দেশে ফেরত আসেন ১০ হাজার ৭১৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৯ হাজার ৫২২ জন, আর নারী এক হাজার ১৯১ জন। পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন ৮ হাজার ২৭০ জন। আউটপাসে এসেছে ২ হাজার ৪৪৩ জন।
আরও জানানো হয়, আকামা বা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় কুয়েত থেকে দেশে ফিরেছেন ৯ হাজার ৯৯৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৯ হাজার ৭৮১ জন, আর নারী ২১৬ জন। পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন ৭ হাজার ৯৬৩ জন। আউটপাসে এসেছে ২ হাজার ৩৪ জন।
অন্যদিকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে ইতালি থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে ১৫১ জন প্রবাসী বাংলাদেশিকে। এই ১৫১ জন প্রবাসী গত ৬ জুলাই বাংলাদেশ থেকে ইতালি গেলে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। পরে দেশে ফিরলে সবাইকে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছিল।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, “করোনার কারণে শ্রমবাজার তথা অভিবাসন খাতে সব দিক থেকে ধাক্কা লেগেছে। শুধু বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন সে ধাক্কা নয়। গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে দেড় লাখের বেশি প্রবাসী কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। তার আগেও ছুটিতে এসে প্রায় দুই লাখ লোক আটকা পড়েছে। এই তিন লাখের পাশাপাশি আমাদের প্রতিমাসে ৬০ হাজার লোক বিদেশ যেতো সেটাও গত ছয় মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। তাহলে ছয় মাসে সাড়ে তিন লাখ লোক যেতে পারেননি। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখের পাসপোর্ট, ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট তৈরি ছিল। সব মিলিয়ে বলা চলে প্রায় ৭ লাখের বেশি অভিবাসী কর্মী ও তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার মানুষ ফিরছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ আরও ২ লাখের মতো মানুষ ফিরবে। ফলে সব দিক থেকেই আমাদের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ”
তিনি বলেন, “এ অবস্থায় সরকারের করণীয় হবে, বিদেশে যে ১ কোটি অভিবাসী কর্মী রয়েছেন, তারা যেন চাকরি না হারান, সে জন্য সরকারকে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। যারা ফেরত এসেছে তাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের দক্ষতা অনুযায়ী দেশেই কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে বা আবার তারা যাতে যেতে পারে বা রিমাইগ্রেন্ট করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৭০০ কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে সেটি দ্রুত কাজে লাগাতে হবে এবং প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা যেন সেটা পায় সেই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ঋণ নীতিমালায় যে শর্ত দেওয়া আছে তা সংশোধন করে আরো সহজ করতে হবে। ”
তিনি আরও বলেন, “একই সঙ্গে নিদিষ্ট কিছু পরিমাণ টাকা একেবারে প্রবাসীদের দিয়ে দিতে পারলে তারা কিছু করে খেতে পারতো। আর যারা টাকা দিয়েও যেতে পারেননি তাদের দিকটা দেখতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদের যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। আর যেতে না পারলে তারা যেন টাকা ফেরত পায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। ”
বিদেশ প্রত্যাগত এসব কর্মীদের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, “বিদেশ প্রত্যাগত কর্মীদের পুনর্বাসনে সরকার ৭০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন এবং তাদের পুনঃপ্রশিক্ষণের মাধ্যমে আবারও বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে বিদেশ প্রত্যাগত কর্মীদের পুনর্বাসন ও প্রবাসে কর্মরতদের নিরাপদ অভিবাসনসহ তাদের সার্বিক কল্যাণে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ” তিনি বলেন, “বিপদগ্রস্ত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জরুরি খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তার জন্য প্রায় ১০ (দশ) কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। কোভিড-১৯ এ মৃত প্রত্যেক প্রবাসী বাংলাদেশির পরিবারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ৩ লাখ টাকা আর্থিক সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিদেশ ফেরত কর্মীদের কোয়ারেন্টিন পালন শেষে নগদ ৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা, বিদেশ প্রত্যাগত অভিজ্ঞ কর্মীদের যথাযথ স্বীকৃতি ও সনদায়নের উদ্যোগ, বিদেশ ফেরত অসহায়, ক্ষতিগ্রস্ত, দরিদ্র কর্মী ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি কর্মীর পরিবারের সদস্যদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিসহ দেশে চলমান সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় মানবিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ”