অর্থনীতির আগের গতি এখনো ফেরেনি
করোনার কারণে থমকে যাওয়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল হতে শুরু করেছে। দুই মাসের টানা সাধারণ ছুটি শেষে মে মাসের শেষ সপ্তাহে সবকিছু খুলে দেয়া হলে ফের ঘুরতে শুরু করে কারখানার চাকা, কর্মস্থলে বাড়তে থাকে লোকসমাগম। তবে কভিড আসার আগে অর্থনীতিতে যে গতি ছিল তা এখনো ফেরেনি। একটি দেশের অর্থনীতির গতি কোন পর্যায়ে আছে তা বোঝার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে উৎপাদন, আমদানি ও রফতানির চিত্র।
আমদানি-রফতানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধান রফতানি খাতের কোনো কারখানায়ই যথেষ্ট ক্রয়াদেশ নেই। কোনো কারখানাই বলছে না যে তারা পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে। যা কাজ আছে সেগুলো মূলত বাতিল-স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশগুলোর মধ্যে পুনর্বহাল করা অংশ। নতুন ক্রয়াদেশ খুবই কম। নতুন ক্রয়াদেশ যদি না আসে তাহলে শিল্প কাঁচামাল আমদানিও কম হবে।
ব্যবসায়ীদের কথার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে চলতি মাসের ১ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত নির্বাচিত অর্থনৈতিক সূচকেও। এতে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট দুই মাসে দেশের মোট আমদানি ১৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে জুলাই মাসেই মূলধনি যন্ত্রের ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমেছে ২৯ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি কমেছে ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
ইন্টারমেডিয়েট গুডস আমদানির ক্ষেত্রেও নেতিবাচক পরিস্থিতি ছিল জুলাই মাসে। ওই মাসে ইন্টারমেডিয়েট গুডসের এলসি খোলা কমেছে ২০ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি কমেছে ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ। একই সময়ে জ্বালানি তেলের এলসি খোলা কমেছে ৫৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি কমেছে ৬৭ দশমিক ১২ শতাংশ। এছাড়া শিল্প কাঁচামালের এলসি খোলা ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি কমেছে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসা যদি না হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই কাঁচামাল আমদানি হবে না। এ অবস্থায় কোনো কারখানায় মূলধনি যন্ত্রের কোনো ঋণপত্রও খোলা হবে না। মানুষ কিসের ওপর ভিত্তি করে মূলধনি যন্ত্র কিনবে? আগে ব্যবসায়ীর কাছে বিদ্যমান ক্রয়াদেশ ও ভবিষ্যতের যথাযথ পূর্বাভাস থাকতে হবে, তারপর সে নতুন মূলধনি যন্ত্র আমদানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এ মুহূর্তে বিদ্যমান ও ভবিষ্যৎ কোনো নিশ্চয়তা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হবে আগামী বছরের এপ্রিল-মে-জুন পর্যন্ত। শিল্পসংশ্লিষ্ট সবাই স্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছে।
সার্বিকভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত বৈশ্বিক জীবনযাপনে স্বাভাবিকতা না আসবে ততদিন পর্যন্ত অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে এবং শ্লথ ধারার প্রবৃদ্ধি দেখা যাবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরি পারভেজনি তিনি বলেন, বাংলাদেশ একা একা কিছু করতে পারবে না, কারণ বিষয়টি বৈশ্বিক। রফতানি ও আমদানি দুই ক্ষেত্রেই আমরা বহির্বিশ্বনির্ভর। বাণিজ্যে বৈশ্বিক প্রভাবটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর সঠিক পদক্ষেপের কারণেই বাংলাদেশের ভাগ্য অনেক ভালো অবস্থায় আছে। তিনি শুরু থেকেই খাদ্যনিরাপত্তায় গুরুত্ব দিয়েছেন। আবার অর্থনীতি সচল রাখতে তার প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকা রেখেছেন। এখন সরকার ব্যয় বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছে। এটি ছাড়া খুব বেশি কিছু করণীয় নেই। আগামী দিনগুলোর জন্য শিল্প খাতকে টেকসই করতে আরো পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন আছে বলেও জানান বিসিআই সভাপতি।
এদিকে অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় বাজারে খুচরা পর্যায়েও উল্লেখযোগ্য বেচাকেনা নেই। নির্মাণ খাতের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাচ্ছে কেউ কোনো বিনিয়োগ করছে না। সবাই নিরাপদ থাকার চেষ্টা করছে। ব্যবসা করে কীভাবে টিকিয়ে রাখা যাবে, সেই পথ বের করতে সবাই কাজ করে যাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ে ভীত ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভবিষ্যতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। কারণ প্রতিদিনই ব্যবসায়ীর দায় সৃষ্টি হচ্ছে এবং তিনি নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে দায় আরো বাড়ছে। এ অবস্থায় কোন ভরসায় ব্যবসায়ী আরো বিনিয়োগে যাবেন, সে প্রশ্নও ছুড়ে দেন কেউ কেউ।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি নিহাদ কবীর বলেন, আমার জানামতে, এসএমইর মধ্যে স্মল বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কর্মকাণ্ড ৯০ ভাগই সচল হয়ে গেছে। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের গতিশীলতা ফিরে এসেছে। কিন্তু কিছু খাত এখনো সম্পূর্ণ সচল হয়ে ওঠেনি। রফতানি-বাজারনির্ভর কিছু কারখানা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে এটাও বাস্তবতা। এদিকে আমদানি-রফতানির প্রতিবন্ধকতা এখনো আছে। কারণ আমদানি-রফতানির উৎস দেশগুলোর অর্থনীতির ওপর এবং কভিড পরিস্থিতির ওপর তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি নির্ভরশীল। এ পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে তার সঠিক প্রক্ষেপণ করাটা প্রায় অসম্ভব। ধারণা করছি আগামী বছর লেগে যাবে।
শিল্পোদ্যোক্তাদের ভাষ্য, যারা কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে বা নিয়োগকর্তা তারা কাজের পরিসর বড় না করে বরং সংকুচিত করছে। কারণ নিয়োগকর্তাকে তার প্রতিষ্ঠানের মাথাপিছু ব্যয়কে বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। সবাই আগামী এক বা দুই বছর মোকাবেলা করতে বেশি মনোযোগী হচ্ছেন। রফতানিমুখী শিল্পোদ্যোক্তারা বিদেশী ক্রেতাদের প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করেই আসন্ন ক্রিসমাস নাগাদ ক্রয়াদেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করছিলেন। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার কারণে পশ্চিমা দেশগুলো দুর্ভোগ মোকাবেলা করছে। এখন পশ্চিমা ক্রেতারাও অনুধাবন করতে পারছেন না যে পরিস্থিতি কোন দিকে এগোচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব মেনেও অর্থনীতির গতি ঘুরছে না। ফলে স্বাভাবিকতার দেখা না পেলে অশ্চিয়তা কাটার কোনো সুযোগ আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
এফবিসিসিআই সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিল্পের মূলধনি যন্ত্রের আমদানি কম হওয়ারই কথা। কারণ এ সময়ে নতুন করে বিনিয়োগে কেউ যাচ্ছে না। পুরো বিশ্ব একটা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর বিশ্লেষণে বলা যায়, এই মহামারীর মধ্যে যদি কোনো দেশ আগে ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে দেশ হবে বাংলাদেশ। আমি মনে করি, আমাদের অর্থনীতিই অনেক ভালো সচল আছে। অন্যান্য দেশের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে এ চিত্রই প্রকাশ পাবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজটাই হলো মূল চাবিকাঠি। সময়মতো সময়োপযোগী ঘোষণা হলে অর্থনীতিতে আরো বড় পতনের শঙ্কা ছিল। মহামারী এখনো অনিশ্চিত অবস্থায় আছে। মানুষের মধ্যে ভয় রয়েই গেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত ভ্যাকসিন না আসবে ততদিন এটা ভাবা ঠিক হবে না যে অর্থনীতি আগের মতো সচল হয়ে যাবে। আমদানি-রফতানি বহির্বিশ্বনির্ভর। সেই দেশগুলোর অর্থনীতি এখনো সচল না। তারা কতটা সচল হলো তার ওপরও নির্ভর করছে আমাদের অর্থনীতির সচলতা।
ব্যবসায়ীদের যখন এ পরিস্থিতি তখন চাকরিজীবীরাও অপ্রয়োজনীয় খরচ থেকে বিরত থাকছেন বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। তারা এখন শুধু অপরিহার্য খরচ যেমন খাওয়া-দাওয়া কাঁচাবাজার মুদি ছাড়া কোনো ভোক্তাই তেমন ব্যয় করছে না। জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই হতভম্ব পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারছে না। স্থানীয় বাজারমুখী উৎপাদনমুখী শিল্পগুলো তাদেরও একই অবস্থা। ভোক্তা যদি ব্যয় না করে তাহলে অর্থনীতি তো শ্লথ হবেই। সাধারণ মানুষ বা ভোক্তার হাতে এখন টাকার স্বল্পতা তো আছেই, আরো ভয়াবহ হলো অনিশ্চয়তা আছে চাকরি নিয়ে।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কভিডের একটা অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। বিদেশের বাজারগুলোও কিছুটা চালু হয়ে এখন সেকেন্ড ওয়েভের মধ্যে পরে প্রবেশ করেছে। চাহিদা ও সরবরাহ দুই ক্ষেত্রের কর্মকাণ্ডই এখনো নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এলসিতে ভ্যালুর বিষয়টি প্রতিফলিত হচ্ছে, পরিমাণে হয়তো একই মাত্রায় নাও হতে পারে, কারণ বৈশ্বিক বাজারে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে অনেক পণ্যের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। এদিকে অভ্যন্তরীণ বাজারও পুরোপুরি চাঙ্গা হয়নি। ফলে ঋণপত্রের তথ্য-উপাত্তে পরিস্থিতির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। পরিস্থিতি একদম স্বাভাবিক হয়ে গেছে তা কিন্তু না। অনেকের আয় কমে গেছে, চাকরি চলে যাচ্ছে, এ অবস্থায় ক্রয়ক্ষমতার সর্বোচ্চটা বাজারে নেই। প্রণোদনা প্যাকেজ বড়দেরটা কার্যকর হলেও ক্ষুদ্র-মাঝারির জন্য প্রণোদনার কার্যকারিতা ৫০ শতাংশও হয়নি। অভ্যন্তরীণ চাহিদার চাঙ্গা ভাব এলে তার প্রতিফল ঋণপত্রেও দেখা যেত। আন্তর্জাতিক বাজারে কমোডিটি প্রাইসের ওপর ডিপ্রেসড অবস্থা গেছে। জ্বালানি তেলের দাম ৬০-৭০ ডলার থেকে কমে ২৫ ডলারে নেমে এসেছে। জ্বালানির দামের সঙ্গে পণ্যের দামের একটা সম্পর্ক আছে।