স্কয়ারের সেকলোকে ছাড়িয়ে ওষুধের শীর্ষ ব্র্যান্ড সারজেল
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, খাদ্যে ভেজাল ও সময়মতো খাবার গ্রহণ না করাসহ নানা কারণে অ্যাসিডিটির সমস্যা বাড়ছে মানুষের। এজন্য অনেকেই নিয়মিত গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ সেবন করে। এতদিন এ ধরনের ওষুধের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সেকলো। সম্প্রতি সেকলোকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ১০ ওষুধের শীর্ষে উঠে এসেছে হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্র্যান্ড সারজেল।
ওষুধের বিক্রি ও ধরন নিয়ে নিয়মিত জরিপ চালিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যপ্রযুক্তি ও ক্লিনিক্যাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইকিউভিআইএ। বহুজাতিক এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ওষুধ বিক্রি হয়েছে মোট ২৩ হাজার ১৮৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় অ্যান্টিআলসারেন্ট বা অ্যাসিডিটির ওষুধ। আর এ ধরনের ওষুধের মধ্যে বিক্রির শীর্ষে ছিল সারজেল। যদিও এর আগে টানা তিন বছর সেকলোর দখলে ছিল এ জায়গা।
ওষুধ শিল্প খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিক্রিতে শীর্ষস্থানে পরিবর্তন ওষুধ পণ্যের লাইফ সাইকেলের স্বাভাবিক গতি। সেকলোর জেনেরিক নাম ওমিপ্রাজল। দেশে অনেক আগে থেকেই এ জেনেরিকের ওষুধ বাজারে আছে। তবে তুলনামূলক নতুন জেনেরিক ইসোমিপ্রাজল। এ জেনেরিকেরই একটি ওষুধের ব্র্যান্ড সারজেল। সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসকের পছন্দ, ওষুধের কার্যকারিতাসহ নানা দিক বিবেচনায় ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্যতা কমছে ওমিপ্রাজলের। অন্যদিকে ব্যবহার বাড়ছে ইসোমিপ্রাজল, র্যাবেপ্রাজল ও লেন্সোপ্রাজল জেনেরিকের ওষুধের, চিকিৎসাবিজ্ঞানে যাকে বলা হয় ‘নতুন ভালো বিকল্পের সূচনা’। এ পরিবর্তনের প্রভাবেই জেনেরিক ইসোমিপ্রাজলের ব্র্যান্ড সারজেল বেশি বিক্রি হচ্ছে।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মার্কেটিং ডিরেক্টর আহমেদ কামরুল আলম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, এটা পণ্যের লাইফ সাইকেলের স্বাভাবিক চিত্র। এরই মধ্যে মেডিকেল সায়েন্সে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ক্যাটাগরিতে আরো লেটেস্ট জেনারেশনের মলিকিউলের উদ্ভব ঘটেছে। ধীরে ধীরে পুরনো জেনারেশনের ওমিপ্রাজলগুলো মার্কেট থেকে সরে আসছে। এটা স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি।
আইকিউভিআইএর তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে দেশের বাজারে সর্বাধিক বিক্রীত ওষুধের ১০টি ব্র্যান্ড ছিল যথাক্রমে হেলথকেয়ারের সারজেল, স্কয়ারের সেকলো, রেনাটার ম্যাক্সপ্রো, ইনসেপ্টার প্যানটোনিক্স, স্কয়ারের সেফ-৩, নভো-নরডিস্কের মিক্সটার্ড ৩০, রেডিয়েন্টের একজিয়াম, অপসোনিনের ফিনিক্স, বেক্সিমকোর নাপা ও বাইজোরান।
আইকিউভিআইএর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে বিক্রীত ওষুধের শীর্ষ ১০ ব্র্যান্ডের মধ্যে শুধু গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধই রয়েছে ছয়টি। বাকিগুলোর মধ্যে আছে অ্যান্টিবায়োটিক একটি, প্যারাসিটামল গ্রুপের দুটি ও অন্যটি ইনসুলিন। শীর্ষ চারের সবগুলোই গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধের ব্র্যান্ড।
শীর্ষ দশের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ব্র্যান্ড সারজেলের বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ছিল ২৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে বিক্রি হয়েছে ৫০০ কোটি ৭৪ লাখ টাকার সারজেল।
হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের (বাপি) ট্রেজারার মুহাম্মদ হালিমুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের ওষুধের বাজারে উৎপাদিত পণ্য কমবেশি সব প্রতিষ্ঠানেরই এক। হেলথকেয়ার কোনো পণ্য প্রথম বাজারে নিয়ে এসেছে, এমনটা নয়। আমি মনে করি, হেলথকেয়ারের কর্মীবাহিনী তুলনামূলক বেশি উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করছে বলেই আমাদের পণ্য বিক্রি বেড়েছে।
সারজেলের পর সর্বাধিক বিক্রীত ওষুধ ছিল স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সেকলো। গত বছর ওষুধটি বিক্রি হয়েছে ৩৭৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকার। বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক। ২০১৮ সালের তুলনায় ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ কমেছে সেকলোর বিক্রি। তৃতীয় স্থানে থাকা রেনাটার ম্যাক্সপ্রো বিক্রি হয়েছে ৩৬১ কোটি ১২ লাখ টাকার। ভ্যাকসিন উৎপাদনে বিখ্যাত হলেও গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ বিক্রি বিবেচনায় চতুর্থ অবস্থানটি ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্যানটোনিক্স। গত বছর এ ওষুধটি বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৪৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
বিক্রির দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে স্কয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক সেফ-থ্রি। ২০১৯ সালে ওষুধটি বিক্রি হয়েছে ১৭৪ কোটি টাকার। বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। বিক্রি বিবেচনায় নভো-নরডিস্কের ইনসুলিন ব্র্যান্ড মিক্সটার্ড ৩০ ছিল তালিকার ষষ্ঠ অবস্থানে। বিক্রির পরিমাণ ১৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা এবং প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ।
গত বছর সপ্তম অবস্থানে থাকা ব্র্যান্ড একজিয়ামের বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৫০ কোটি ২৮ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। বিক্রিতে অষ্টম অবস্থানে থাকা ওষুধের ব্র্যান্ড অপসোনিনের ফিনিক্স। ২০১৯ সালে ওষুধটির বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৩৪ কোটি ১১ লাখ টাকা। নবম অবস্থানে থাকা নাপা বিক্রি হয়েছে ১৩৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকার। নবম ও দশম স্থানে থাকা দুটো ওষুধই বেক্সিমকোর। গত বছর ওষুধ দুটির বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ২১ দশমিক ৫৮ ও ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর দশম অবস্থানের বাইজোরান বিক্রি হয়েছে ১৩৩ কোটি ৫২ লাখ টাকার। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহূত বাইজোরানের বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ২০১৯ সালে ছিল ৩৯ দশমিক ১৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, সময়মতো খাবার না খাওয়া, ভেজাল খাবার, ফাস্টফুড, অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া, ধূমপান ও মদ্যপানের কারণে মানুষের মধ্যে অ্যাসিডিটি সমস্যা বাড়ছে। অন্যদিকে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই এ ওষুধ সেবনের সুযোগ থাকায় মানুষের মধ্যে তা গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ কেনার প্রবণতাও বাড়ছে। তবে কোন ব্র্যান্ডের ওষুধ বেশি বিক্রি হচ্ছে, তা মানুষের শরীরে কার্যকারিতার পাশাপাশি ওষুধ কোম্পানির বিপণন কৌশলের ওপরও নির্ভর করে।
এ বিষয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. স্বপন চন্দ্র ধর বণিক বার্তাকে বলেন, গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধের বিক্রি বৈশ্বিকভাবেই বেশি। এর ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশও। সাম্প্রতিক সময়ে ওমিপ্রাজলের চেয়ে ইসোমিপ্রাজলের চাহিদা যেমন বাড়ছে, তেমনি চিকিৎসকরা র্যাবেপ্রাজল, লেন্সোপ্রাজলও ব্যবহারের পরামর্শও দিচ্ছেন। ব্র্যান্ড যেটাই হোক সেটার পরিচিতি বা জনপ্রিয়তার পেছনে কোম্পানির বিপণন কৌশলও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশে ২৩ হাজার ১৮৪ কোটি টাকার ওষুধের বাজারে ৬৮ শতাংশই ১০টি কোম্পানির দখলে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে যথাক্রমে স্কয়ার, ইনসেপ্টা, বেক্সিমকো, হেলথকেয়ার, রেনাটা, অপসোনিন, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল, অ্যারিস্টোফার্মা, এসিআই ও এসকায়েফ। এর মধ্যে বার্ষিক হাজার কোটি টাকার বেশি ওষুধ বিক্রি হয় এমন কোম্পানির সংখ্যা সাতটি।