হুইলচেয়ারে বসে বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন
সিআরপিতে থেরাপি নেওয়ার সময় ঘণ্টাখানেক খেলার সুযোগ পেতেন মারজানা। সেখানে অন্য খেলা বাদ দিয়ে বাস্কেটবলে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। ছেলেবেলার চঞ্চলতা হয়তো খুঁজে পেয়েছিলেন এ খেলায়! তাকে খেলতে দেখেই সিআরপির বাস্কেটবল কোচ মেয়েদের নিয়ে দল গঠনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মেয়েটা ঘুরে বেড়ায় মনের আনন্দে। গ্রামের সবুজ-শ্যামল পরিবেশে খেলাধুলায় মেতে থাকে। গাছের ডাল বেয়ে ওপরে উঠে আকাশ ছুঁতে চায়। এভাবেই এক দিন গাছের ডালে বসে স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে সেই ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়। মেরুদন্ডে বড় ধরনের আঘাত পায়। হাত-পা অবশ হয়ে যায়। আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন কি তবে শেষ! ভাঙা মন নিয়ে কেবল বিছানায় পড়ে থাকাই হবে বাকি জীবনের বিধিলিপি!
হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দলের অধিনায়ক মারজানা আক্তার জীবন স্রোতের তোড়ে ভেসে যেতে পারতেন। পাড়ার লোকদের কটুকথায় ভাঙা মন নিয়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকতেন হয়তোবা! কিন্তু তিনি প্রবল স্রোতের বিপরীতে ঠায় দাঁড়িয়ে যান। অপ্রতিরোধ্য গতি আর অদম্য সাহস বুকে নিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যান। মনের ভয়কে জয় করে এবার তিনি স্বপ্ন দেখছেন বিশ্ব জয়ের।
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ফরিদপুর নামক গ্রামের মেয়ে মারজানা ২০১৫ সালের ৬ জুন গাছের ডাল ভেঙে পড়ে যান। মেরুদন্ডে ভয়ানক আঘাত পান। নিউরো সায়েন্স ও ঢাকা মেডিকেল ঘুরে অপারেশন করান হেলথ অ্যান্ড হোপ নামক হাসপাতালে। এরপর ডাক্তারের পরামর্শেই আসেন সিআরপিতে। এখানে এক নতুন জীবনের সন্ধান পান মারজানা। চলে ফিজিও থেরাপি। পাশাপাশি চলতে থাকে কাউন্সিলিং। এক সময় চরম সত্যটাকে খুবই সহজভাবে মেনে নেওয়ার মতো মানসিক শক্তি জুুগিয়ে নেন। প্রতিবন্ধিতাকে জয় করার সাহস নিয়ে সামনে ছুটে চলার প্রেরণা খুঁজে নেন।
সিআরপিতে থেরাপি নেওয়ার সময়ই বিকালে ঘণ্টাখানেকের জন্য খেলার সময় পেতেন মারজানা। সেখানে অন্য খেলা বাদ দিয়ে বাস্কেটবলে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। ছেলেবেলার চঞ্চলতা হয়তো খুঁজে পেয়েছিলেন এই খেলায়! তাকে খেলতে দেখেই সিআরপির বাস্কেটবল কোচের মাথায় মেয়েদের নিয়ে দল গঠনের আগ্রহ দেখা দেয়। পরবর্তীতে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড কোর্স (আইসিআরসি) ২০১৬ সালের মার্চ মাসজুড়ে একটা বাস্কেটবল ক্যাম্প করে মেয়েদের নিয়ে। ১৬-২০ জন প্লেয়ার ছিল সেই দলে। সবার ছোট ছিলেন মারজানা। বড়দের আদর আর কোচের উৎসাহে নিজেকে একজন যোগ্য খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি। এরপর ক্যাম্প হলেই ডাক পড়ত মারজানার।
২০১৭ সালে নেপালে একটি আন্তর্জাতিক বাস্কেটবল টুর্নামেন্ট হয় হুইলচেয়ার মেয়েদের নিয়ে। সেবারই সিলেকশন ক্যাম্পে মারজানার দক্ষতা দেখে তাকেই অধিনায়কের পদটা দেওয়া হয়। নেপালের সেই টুর্নামেন্টে রানার্সআপ হয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ায় খেলতে গিয়ে স্বাগতিক দলকে পাঁচ ম্যাচে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন মারজানারা। তিনি বলেন, ‘নেপালে আমরা প্রথমবারের মতো খেলতে গিয়েছিলাম। ইন্দোনেশিয়াতে সেই অভিজ্ঞতা খুব কাজ দেয়। আমরা চ্যাম্পিয়ন হই।’ ২০১৯ সালে থাইল্যান্ডে ডেভেলপমেন্ট ক্যাম্প করতে যায় দলটা। বর্তমানে ২০ জন খেলোয়াড় থাকলেও কোথাও খেলতে গেলে দশজনের দল নিয়েই যান মারজানারা। এখন তার দাবি, হুইলচেয়ার নারী দলকে জাতীয় দল হিসেবে গঠন করা হোক ফেডারেশনের অধীনে।
এখনো ফেডারেশন সহযোগিতা দেয়। তবে মারজানা চান প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। এরপরই তিনি ছুটতে চান বিশ্ব জয়ের লক্ষ্যে। খেলতে চান প্যারা অলিম্পিকে। সোনার পদক জয় করতে চান। মারজানা ছাড়াও সোনিয়া, শাকিলা মিতু, ফাহিমা আক্তার, সাবিনা আক্তার, রত্না আক্তার নদীদের চোখেও এখন একই স্বপ্ন। এসএসসিতে ৪.৮ এবং এইচএসসিতে ৪.২৫ ফল করা মারজানা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টির অধীনে বিএসসি ইন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি নিয়ে পড়ছেন বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড প্রফেশন ইনস্টিটিউটে। স্পিচ থেরাপি নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে চান। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে কাজ করতে চান।