ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিক এখন একজন ভারতীয়
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত চেনা একটি নাম। বাণিজ্যের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রবেশ করে কয়েক শতাব্দী শাসন ও শোষণের দ্বারা পুরো উপমহাদেশ কবজা করে রাখার ইতিহাসই এই নামটিকে এনে দিয়েছে চিরস্থায়ী পরিচিতি। এটিকে বলা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং প্রথম করপোরেশন কোম্পানি। শুরুতে এর নাম ছিল ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৬০০-১৭০৮)। পরবর্তীতে এর নাম বদলে করা হয় অনারেবল কোম্পানি অব মার্চেন্টস অব লন্ডন ট্রেডিং ইনটু দ্য ইস্ট ইন্ডিজ অথবা ইউনাইটেড কোম্পানি অব মার্চেন্টস অব ইংল্যান্ড ট্রেডিং টু দ্য ইস্ট ইন্ডিজ (১৭০৮-১৮৭৩)। তবে উপমহাদেশে সেটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামেই অধিক পরিচিত ছিল।
আগে ইউরোপের মানুষের কাছে ভারতীয় উপমহাদেশ ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত ছিল। সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল মশলা, কাপড় এবং দামি রত্নের জন্য বিখ্যাত এক স্থান। এসব উপকরণ ইউরোপে বেশ চড়া দামে বিক্রি হতো। কিন্তু সমুদ্রে শক্তিশালী নৌবাহিনী না থাকার দরুণ ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসতে ব্যর্থ হয়। সেই সময়ে স্পেন এবং পর্তুগাল ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে মশলা ও কাপড় নিয়ে পূর্বের দূরবর্তী দেশ সমূহে বিক্রি করত। কিন্তু ব্রিটিশ বণিকরা উপমহাদেশে আসার জন্য মরিয়া হয়ে ছিলেন। অবশেষে ১৫৮৮ সালে ব্রিটিশরা পথের দিশা পায়। স্প্যানিশদের হারিয়ে তাদের নৌবহরের দখল নিয়ে নেয় তারা। এই নৌবহর ব্রিটিশদের ভারতের আসার পথ তৈরি করে দেয় এবং সেই সাথে তাদের নৌশক্তি বহুগুণে বেড়ে যায়।
১৬০০ সালের স্যার থমাস স্মাইথের নেতৃত্বে লন্ডনের একদল বণিক রাণী প্রথম এলিজাবেথের কাছে এক আর্জি নিয়ে হাজির হন। তারা রাণীর কাছে পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবসা করার জন্য রাণীর সম্মতি ও রাজসনদ প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন। রাণী প্রথম এলিজাবেথ তাদের সম্মতি দেন। পরবর্তীতে ৭০ হাজার পাউন্ড পুঁজি নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়।
কোম্পানি থেকে শাসক
শুরুতে মুঘল সাম্রাজ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া ছিল শুধুমাত্র একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশরা ভারতের রাজনীতিতে প্রভাব খাটানো শুরু করে।
রাণী এলিজাবেথ শুরুতেই কোম্পানিকে তাদের যেকোনও প্রয়োজনে সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এছাড়া মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি কমে যাওয়ায় দিল্লি থেকে দূরবর্তী রাজ্যগুলোতে কেন্দ্রের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। আর এর সুবিধা নিয়ে ব্রিটিশরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবসা জোরদার করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
এদিকে ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো ভারতে তাদের উপস্থিতি বাড়াতে শুরু করে। বিশেষ করে ব্রিটেনের জাতীয় শত্রু ফ্রান্সের ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভাবিয়ে তোলে। ফলে তখন তারা ভারতের রাজনীতি দখলের পরিকল্পনা আঁকতে শুরু করে।
শুরুতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক দক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলে। পাশাপাশি ভারতের উপকূলে তাদের অবস্থান ছিল শক্তিশালী। এছাড়া যেকোনও প্রয়োজনে তাদের ডাকে ব্রিটিশ নৌবাহিনী সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। সামরিক দিক দিয়ে এগিয়ে থাকার কারণে ভারতের বিভিন্ন যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হয়।
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ এবং ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর কোম্পানি বাংলার কর সংগ্রহের ক্ষমতালাভ করে। ভারতের রাজনীতির দখল নেওয়ার জন্য বাংলা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পুরো ভারতে প্রভাব তৈরির জন্য বাংলাই কেবল যথেষ্ট ছিল না।
এ কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে। এরপর পশ্চিম ভারতের মারাঠা এবং মহীশূরের রাজা টিপু সুলতানকে হারানোর পর পুরো ভারতই কার্যত তাদের অধীনে চলে যায়৷ মুঘল সম্রাটরা তখন পুতুল শাসকে পরিণত হয়। ১৮১৮ সালের হিসেব অনুসারে ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে ছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বর্তমান অবস্থা
মূলত ১৮১৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাঠামোর ভেঙে পড়ে। কিন্তু পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায় ১৮৭৪ সালে। এর প্রায় ১৩৫ বছর পর ২০১০ সালের আগস্টে আবারো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সচল হয়েছে। তবে এক ভারতীয় ব্যবসায়ীর হাত ধরে। তার নাম সঞ্জীব মেহতা। মূলত পূর্বের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে এই কোম্পানির নাম ছাড়া আর কোনও কিছুতেই মিল নেই।
৪৮ বছর বয়সী ভারতীয় ব্যবসায়ী সঞ্জীব মেহতা ২০০৫ সালে স্বল্প মূল্যে ইস্ট কোম্পানির পেটেন্ট ক্রয় করেন। এর পাঁচ বছর তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভোগ্য পণ্যের ব্র্যান্ডে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতোমধ্যে তিনি লন্ডনে বিলাসবহুল এক খাবারের দোকান চালু করেছেন। মাত্র ৩৫ জন কর্মীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানে মেহতার বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১২ মিলিয়ন পাউন্ড। সূত্র: আরব নিউজ, ডব্লিউআইওনিউজ, রোর মিডিয়া