করোনা মহামারির কারণে বড় ধাক্কা লেগেছে বৈদেশিক শ্রমবাজারে। বিভিন্ন দেশে লকডাউন, জরুরি অবস্থার কারণে শিল্পকারখানা, সেবা ও নির্মাণ খাত বন্ধ হওয়ায় কাজ হারিয়েছেন অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী। গত পাঁচ মাসে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন সোয়া লাখের বেশি কর্মী। ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন প্রায় ২ লাখ। এর মধ্যে ইরাক থেকে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন ১৪ হাজারের বেশি কর্মী। কিন্তু ইরাকে বাংলাদেশ দূতাবাস যথাযথ পদক্ষেপ নিতে গড়িমসি করায় তারা ফিরতে পারছেন না। অন্যদিকে করোনার আগে বিভিন্ন সময়ে ছুটিতে দেশে এসে আটকা পড়েছেন প্রায় ২ লাখ কর্মী। সব মিলিয়ে বলা যায়, এই মুহূর্তে ৫ লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মহীন রয়েছেন। এছাড়া শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়েছেন আরো প্রায় ৩ লাখ লোক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরালো করতে হবে।
করোনার কারণে বিমান চলাচল স্বাভাবিক না হলেও প্রতিদিনই হাজার হাজার কর্মী দেশে ফিরছেন। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত ১ এপ্রিল থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন ১ লাখ ২৭ হাজার ২০৯ জন কর্মী। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী ১ লাখ ১৫ হাজার ৫০৬ জন। আর নারী কর্মী ১১ হাজার ৭০৩ জন। সূত্র জানায়, মোট ২৮টি দেশ থেকে কর্মীরা দেশে ফিরেছেন। সবচেয়ে বেশি ৩৬ হাজার ৫৩৩ জন ফিরেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে। করোনার নেতিবাচক প্রভাবে কর্মস্থল বন্ধ হওয়ায় ফিরতে বাধ্য হয়েছেন বেশির ভাগ কর্মী। এর পরই সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন ২৬ হাজার ২০৪ জন। করোনার কারণে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে পর্যটননির্ভর অর্থনীতির দেশ মালদ্বীপ। দেশটি থেকে ফিরেছেন ৯ হাজার ৩০২ জন। কাজ না থাকায় কাতার, মালয়েশিয়া, ইতালি থেকেও দেশে ফিরেছেন আরো প্রায় ১৫ হাজার কর্মী।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান ইত্তেফাককে বলেন, করোনার কারণে অভিবাসন খাতে অনেক বড় ধাক্কা লেগেছে। করোনার কারণে বিদেশে নতুন কর্মী যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতি মাসে গড়ে ৬০ হাজার করে যদি ধরা হয়, তাহলে পাঁচ মাসে তিন লাখ লোক যেতে পারেননি। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখের পাসপোর্ট, ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট তৈরি ছিল। আবার এই পাঁচ মাসে দেশে এসেছেন সোয়া লাখের বেশি কর্মী। অন্যদিকে ছুটিতে এসে আটকা পড়েছেন প্রায় ২ লাখ কর্মী। সব মিলিয়ে বলা চলে, ৫ লাখের বেশি অভিবাসী কর্মী ও তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার মানুষ ফিরছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ আরো ২ লাখের মতো মানুষ ফিরবে।
এ অবস্থায় সরকারের পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, করণীয় তিন ধরনের হতে পারে। প্রথমত, যারা টাকা দিয়েও যেতে পারেননি তাদের দিকটা দেখতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদের যাওয়ার সুযোগ করতে হবে। আর যেতে না পারলে তারা যেন টাকা ফেরত পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিদেশে যে ১ কোটি অভিবাসী কর্মী রয়েছেন, তারা যেন চাকরি না হারান, সে জন্য সরকারকে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোকে মনে করিয়ে দিতে হবে যে তাদের উন্নয়নে বাংলাদেশি কর্মীদের শ্রম রয়েছে। এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি বড় দায়িত্ব। তৃতীয়ত, যারা ফেরত এসেছে তাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের দক্ষতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ দিতে হবে।
ইরাক থেকে দেশে ১৪ হাজার ফেরা নিয়ে তুলকালাম
গত কয়েক মাস ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক থেকে দেশে আসার অপেক্ষায় আছেন ১৪ হাজারের বেশি বাংলাদেশি কর্মী। কাজ হারানো কর্মীদের বেশির ভাগই হানওয়া, হুন্দাইসহ তিনটি বড় কোম্পানির। তাদের অভিযোগ হানওয়া ও হুন্দাই কোম্পানি কর্মীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কয়েক মাস আগে উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু তখন বাগদাদস্থ বাংলাদেশ দূতবাস ভাড়া বিমান পরিচালনায় উদ্যোগ নেয়নি।
কয়েকজন কর্মী জানান, কাজ হারানোর পর তারা কঠিন সংকটের মুখে পড়েছেন। অথচ দূতাবাস নানা অজুহাত দেখিয়ে সময় নষ্ট করছে। তারা সমস্যার মধ্যে থাকলেও দূতাবাস থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না। ভিসা সত্যায়ন, পাসপোর্ট নবায়ন, ট্রাভেল পাস ইস্যুসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দূতাবাস প্রতিটি কাজের জন্য নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ দালালদের মাধ্যমে আদায় করছে। ফলে কর্মীরা অনেক ক্ষেত্রে জিম্মি হয়ে পড়েছেন।
তবে ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবু মাকসুদ এম ফরহাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার দাবি অভিবাসী কর্মীদের দেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছেন তারা। তিনি জানান, হানওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি সাড়ে ৯ হাজার এবং হুন্দাই কোম্পানি সাড়ে ৪ হাজার কর্মীকে ২০২১ সালের মধ্যে দেশে ফেরত পাঠাতে চায়। ইতিমধ্যে প্রায় ৬ হাজার কর্মী দেশে ফিরেছেন। বাকিরাও আস্তে আস্তে ফিরে যাবেন। উল্লেখ্য, ইরাকে প্রায় আড়াই লাখ বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে ২০ হাজারের বেশি কর্মী করোনার কারণে কাজ হারিয়েছেন।
কাজ হারিয়ে কর্মীদের ফেরত আসার বিষয়ে সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ সংসদে বলেছেন, করোনা মহামারি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বব্যাপী শ্রমবাজার হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। অন্যতম কর্মী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে বিদেশ থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক নয়।
তিনি জানান, কর্মীদের দেশে আনা এবং ফেরত আসাদের রিইন্টিগ্রেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে দক্ষ কর্মীদের বিদেশে পাঠানো যায় সে লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় কাজ করছে।