অর্থনীতিলিড নিউজ

এক দশকে নতুন করে আর্থিক সেবায় যুক্ত হয়েছে ৫০% মানুষ

 এক দশকে নতুন করে আর্থিক সেবায় যুক্ত হয়েছে ৫০% মানুষ এক দশক আগেও ব্যাংকিং ছিল শহুরে সেবা। মোট জনগোষ্ঠীর ৮৫ শতাংশই ছিল ব্যাংকিং সেবার বাইরে। ঋণের জন্য নিম্ন আয়ের মানুষের ভরসা ছিল গ্রাম্য মহাজন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অর্থ সঞ্চয়ে ভরসা ছিল মাটির ব্যাংক। দেশের অভ্যন্তরে শ্রমজীবী মানুষের টাকা পাঠানোর প্রধান মাধ্যম ছিল মানুষই। মাত্র এক দশকেই পুরোপুরি পাল্টে গেছে এ চিত্র। বর্তমানে ৬৫ শতাংশের বেশি মানুষই আর্থিক সেবার আওতায় রয়েছে।

প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে গত এক দশকে দেশের আর্থিক খাতে যুক্ত হয়েছে নিত্যনতুন ব্যাংকিং সেবা। এ সেবার সূচনা হয়েছিল মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বা এমএফএসের হাত ধরে। এরপর যুক্ত হয়েছে এজেন্ট ব্যাংকিং, বুথ ব্যাংকিং, উপশাখার মতো নিত্যনতুন ব্যাংকিং ধারণা। এতেই পাল্টে গেছে ব্যাংকিংয়ের চিত্র। শহুরে চরিত্র থেকে বেরিয়ে ব্যাংক পৌঁছে গেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ফলাফল আর্থিক সেবার আওতায় চলে এসেছে ৬৫ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত এক দশকে দেশে ব্যাংক আমানত বেড়েছে ২৯৮ শতাংশ। এ সময়ে ১৮৪ শতাংশ বেড়েছে ব্যাংকে আমানতকারীদের হিসাব সংখ্যা। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণকারী গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে ২৪ শতাংশ। আর ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে ৩৩৭ শতাংশ। এর বাইরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হয়েছেন ৯ কোটি ২৫ লাখ গ্রাহক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক উন্নতির প্রাথমিক ধাপই হলো শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা। জনগোষ্ঠীর যত বেশি অংশ ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসবে অর্থনীতি ততটাই শক্ত ভিত পাবে। এ তাগিদ থেকেই গত এক দশকে দেশে নতুন করে অন্তত ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠী ব্যাংকের ছাতার নিচে এসেছে। যুগোপযোগী নীতি প্রণয়ন, নীতির উদারীকরণ ও ব্যাংকারদের সচেতনতা বৃদ্ধির কারণেই ব্যাংকিং সেবা এতটা সম্প্রসারিত হয়েছে।

ব্যাংকিং  সেবা সম্প্রসারণের এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিজেদের প্রযুক্তি আধুনিকায়নের মাধ্যমে  বৈপ্লবিক এ পরিবর্তন শুরু করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় সিবিএসপি প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ পরিবর্তনের শুরু হয়। প্রায় ৪১ মিলিয়ন ডলারের এ প্রকল্পের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ঢেলে সাজানো হয়। নতুন প্রযুক্তির ওপর ভর করেই ব্যাংকিং খাতে যুক্ত হয় নিত্যনতুন সেবা। কৃষকদের জন্য ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব চালু, মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, বুথ ব্যাংকিং, উপশাখা, ন্যানো লোনসহ বিভিন্ন সেবার মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আসতে থাকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। নতুন করে ব্যাংকিং সেবায় যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে ভার্চুয়াল ব্যাংক, ডিজিটাল শাখাসহ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বিভিন্ন সেবা।

এক দশকে ব্যাংকিং সেবায় এমন পরিবর্তনের  বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা থেকেই দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তির আধুনিকায়ন করা হয়। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে এ কাজের তদারকি করার। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সিবিএসপি প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের একটি প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছিল। তার ওপর দাঁড়িয়েই আমরা ২০১১ সালে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস চালু করেছিলাম। সবার হাতে থাকা মোবাইল ফোনকে কাজে লাগাতেই উদ্যোগটি নেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকিং চালুর ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে গেছে। সে সময় প্রযুক্তির উন্নয়নে করা বিনিয়োগই করোনা মাহামারীতে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা রেখেছে। ভবিষ্যতে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আরো বেশি আধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৯ সাল শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীদের হিসাব সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার ৩২১। গত এক দশকে তা বেড়ে ১১ কোটি ছাড়িয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীদের হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৫৮১। হিসাব সংখ্যার চেয়েও বেশি বেড়েছে ব্যাংকে আমানতকৃত অর্থের পরিমাণ। ২০০৯ সাল শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের আমানত ছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক আমানতের পরিমাণ ১২ লাখ ১০ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সে হিসেবে এ সময়ে ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

এক দশকে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণকারী গ্রাহকের সংখ্যা ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৯ সালে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণকারী গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ৮৭ লাখ ৮৩ হাজার ৫২৩। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণকারী গ্রাহকের সংখ্যা ১ কোটি ৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯৩৩-এ দাঁড়িয়েছে। গ্রাহকের হিসাব সংখ্যা সাড়ে ২৩ শতাংশ বাড়লেও এক দশকে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩৩৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০০৯ সালে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৩৩ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে এ ঋণ ১০ লাখ ২১ হাজার ১০৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এক দশকে দেশের অর্থনীতিতে এক ডজনের বেশি নতুন ব্যাংক যুক্ত হয়েছে। দেশে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬০। এসব ব্যাংকের শাখা রয়েছে ১০ হাজার ৫৮৩টি। ২০০৯ সাল শেষে ব্যাংকের শাখা ছিল ৭ হাজার ৩২৭। সে হিসেবে গত এক দশকে ব্যাংকের শাখা ৩ হাজার ২৫৬টি বেড়েছে।

সময়ের চাহিদা অনুযায়ি নীতি প্রণয়ন ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর ফলে দেশে ব্যাংকিং সেবার আওতা বেড়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, উপশাখাসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ব্যাপক মাত্রায় জোর দিয়েছে। এতে ক্রমেই বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থা ‘ক্যাশলেস’ সোসাইটিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, করোনা মহামারীতে আমরা ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তিগত উত্কর্ষের সুবিধা পেয়েছি। ছয় মাস ধরে গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্ন ব্যাংকিং সুবিধা পেয়েছেন। লকডাউনের মধ্যে ব্যাংকে না গিয়েও গ্রাহকরা সেবা নিতে পেরেছেন। এ সময়ে দেশের কোথাও ব্যাংকিং সেবার বড় ধরনের কোনো সংকট হয়নি। তবে মহামারী আমাদের ব্যাংকিং খাতের শক্তি ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করার নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

ব্যাংকবহির্ভূত জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বা এমএফএস। ২০১১ সালে চালু হওয়া এ সেবা গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ১৫টি ব্যাংক। গত জুলাই পর্যন্ত এমএফএস সেবার গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ কোটি ২৫ লাখ ৭৩ হাজার ২১৩। এর মধ্যে নিয়মিত লেনদেন করেন এমন গ্রাহকের সংখ্যা ৪ কোটি ২৬ লাখ ৭৮ হাজারের বেশি। জুলাইয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ৬২ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা। প্রতিদিন লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৩২ কোটি টাকার বেশি। করোনা মহামারীতে রফতানিমুখী শিল্পের ২৬ লাখ শ্রমিককে চার মাসের বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। প্রণোদনা হিসেবে সরকার থেকে ঋণ হিসেবে দেয়া এ অর্থ বিতরণে মোবাইল ব্যাংকিংই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে ভূমিকা রেখেছে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে এ সেবাটি চালু হয়েছে ২০১৩ সালে। সাত বছরে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে সেবাটি। জুন পর্যন্ত দেশের ২৮টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালুর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েছে। গত এক বছরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ১১৫ শতাংশ। জুন শেষে এজেন্টের মাধ্যমে ব্যাংক হিসেব খুলেছেন ৭৩ লাখ ৫৮ হাজার ১৯০ জন গ্রাহক।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে ভূমিকা রেখেছে ১০ টাকা, ৫০ টাকা ও ১০০ টাকায় চালু করা বিশেষ হিসাবও। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বিশেষ শ্রেণীর এ হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ১৩ লাখ ৭৮ হাজার ৭৫৮টি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক, অতিদরিদ্রসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ ব্যাংকে হিসাব খোলার মাধ্যমে সেবার আওতায় এসেছে।

একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা ও ব্যাংকারদের সচেতনতা দেশে ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে দাবি করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, গত এক দশকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে। এতে বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। ব্যাংকগুলো নিজেদের বড় করা ও টিকে থাকার স্বার্থেই গ্রাহকদের কাছে আমানতের জন্য ছুটে গেছে। ফলে ব্যাংকের সেবা প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়েছে। প্রযুক্তির সমৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংক নিত্যনতুন সেবা চালু করছে। এতে আগামী দিনে দেশে ব্যাংকিং সেবার আওতা আরো বড় হবে।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button