গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের যে শহরে প্রথম নতুন করোনাভাইরাসের উপস্থিতি মিলেছিল, সেই উহানেরই একটি ওয়াটার পার্কে এবার এক মিউজিক ফেস্টিভ্যালে কাঁধে কাঁধ লাগানো ভিড়ে মাস্কবিহীন কয়েক হাজার মানুষকে ভাসমান রাবারে জলকেলি ও উল্লাস করতে দেখা গেছে। সপ্তাহান্তে উহানের মায়া বিচ ওয়াটার পার্কে এ প্রাণোচ্ছ্বল তরুণ তরুণীদের ভিড় ও কোলাহলের ছবি দেখে মনে হচ্ছে বাকি বিশ্ব এখনও যে প্রাণঘাতী ভাইরাসের মোকাবেলায় প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে, তা বোধহয় উহান থেকে পালিয়েই গেছে।
হোহা ইলেকট্রিক মিউজিকাল ফেস্টিভ্যালে সপ্তাহান্তে সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক ছাড়া কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতির বেশকিছু ছবি এরই মধ্যে অনলাইনে ভাইরাল হয়ে গেছে বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। জানুয়ারিতে বিশ্বের প্রথম কোভিড-১৯ রোগী পাওয়া শহরটির কয়েক মাস আগের চিত্রও এর একেবারেই বিপরীত ছিল। সে সময় গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন ছবিতে উহানকে জনমানব ও যানবাহনহীন ভুতুড়ে রূপে দেখা গেছে।
সংক্রমণ প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষের একের পর এক আগ্রাসী পদক্ষেপের পর এপ্রিলে হুবেই প্রদেশের এ রাজধানী শহর থেকে লকডাউন তুলে নেওয়া হয়। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত উহানের পাশাপাশি হুবেইয়ের কোথাও স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত কোনো কোভিড-১৯ রোগীর সন্ধান মেলেনি।
চারশ’র বেশি রোগী শনাক্ত ও ১৭ জনের মৃত্যুর পর ২৩ জানুয়ারি কর্তৃপক্ষ উহানে লকডাউন দেয়। এরও এক সপ্তাহ আগে চীন নতুন করোনাভাইরাসটি যে ছোঁয়াচে, তা নিশ্চিত করেছিল।
লকডাউনের কারণে এক কোটি ১০ লাখ বাসিন্দার শহরটি চীনের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে; পরের কয়েক মাসে শহরটির হাজার হাজার লোকের দেহে ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্তে পরীক্ষা করা হয়; শনাক্ত রোগী ও তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের পাঠানো হয় কোয়ারেন্টিনে।
মার্চের দিকে শহরটির কঠোর লকডাউনের বিধিনিষেধ একটু একটু করে শিথিল করতে থাকে কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি বাড়ির একজন করে সদস্যকে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টার জন্য বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
শপিং মলগুলো খুলে দেওয়া হয়, গণপরিবহন চালু করা হয়। লোকজন ধীরে ধীরে বাইরে আসতে শুরু করলেও শহরটিতে তখনো সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক পরার নির্দেশনা বহাল ছিল।
এপ্রিলের ৮ তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন তুলে নেওয়া হয়। কয়েক মাস ধরে আটকে থাকা বিয়ের আয়োজনগুলোও ফের শুরু হয়। স্কুল খুলে দেওয়া, গণপরিবহন চালু ও ব্যবসা-বাণিজ্যের চাকা ধীরে ধীরে সচল হতে থাকায় শহরটির বাসিন্দারা ফের স্বাভাবিক জীবনযাপনের চিন্তা শুরু করলেও ১২ মে নতুন করে ছয়জনের দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি মেলার পর কর্তৃপক্ষ ফের সতর্ক হয়ে যায়।
শহর কর্তৃপক্ষ সেসময় যত দ্রুত সম্ভব শহরের সব বাসিন্দার করোনাভাইরাস শনাক্তে পরীক্ষা করার পরিকল্পনাও নেয়। কর্তৃপক্ষের পরিকল্পিত ও আগ্রাসী পদক্ষেপের কারণে অল্প সময়ের মধ্যে উহানের নতুন প্রাদুর্ভাবও নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। জুনে নাইট মার্কেটগুলো খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। এক মাস পর চীনের বেশিরভাগ অংশেই জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে। বেশিরভাগ এলাকার সিনেমা হলগুলো খুলে দেওয়া হয়। সুনির্দিষ্ট কিছু পার্ক, লাইব্রেরি ও জাদুঘর অর্ধেক সক্ষমতা নিয়ে খোলে। বড় বড় সমাবেশ আয়োজনেরও অনুমতি মেলে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে উহানের পরিস্থিতি যে অনেকটাই স্বাভাবিক হোহা ইলেকট্রিক মিউজিকাল ফেস্টিভ্যালে অংশ নিতে যাওয়া হাজার হাজার মানুষের ছবিই তার প্রমাণ দিচ্ছে। ফেস্টিভ্যালে বেশি লোকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আয়োজকরা নারী পর্যটকদের টিকেটের মূল্যও অর্ধেক করে দেয় বলে জানিয়েছে বিবিসি।
মায়া ওয়াটার পার্কের মালিকানাধীন উহান হ্যাপি ভ্যালি ২৫ জুন থেকে ফের চালু হলেও অগাস্ট থেকেই লোকজনের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার। গত সপ্তাহান্তে প্রায় ১৫ হাজার দর্শনার্থী পার্কে এসেছিলেন, এ সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অর্ধেক, বলেছেন তিনি।
চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকেই উহানের ওয়াটার পার্কে এত বড় অনুষ্ঠানে কী করে অনুমতি পেল, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
ফেইসবুক ও টুইটার ব্যবহারকারী অনেকে শহরটিতে নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন। যদিও মে মাসের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত উহানে স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত কোনো রোগী মেলেনি।
শহরটির প্রায় ৯৯ লাখ বাসিন্দার শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্তে পরীক্ষাও করা হয়েছে। হুবেই প্রদেশের এ রাজধানীতে এখন বড় জমায়েতে নিষেধাজ্ঞাও নেই।
আট মাস আগে নতুন করোনাভাইরাসে ত্রস্ত উহানের পরিস্থিতি এখন সন্তোষজনক হলেও বিশ্বের বহু অঞ্চলে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের দাপট অব্যাহত আছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২ কোটি ১৯ লাখেরও বেশি মানুষের কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সফল বলে বিবেচিত নিউ জিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতেও ফের নতুন করে প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। যে কারণে উহানের মতো ভিড়ঠাসা অনুষ্ঠানের অনুমতি দিতে বিশ্বের বেশিরভাগ অংশকেই আরও অনেক দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।