শিল্প বিপ্লবের অগ্রদূত, বরেণ্য রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী হারুনার রশিদ খান মুন্নুর চলে যাওয়ার তিন বছর অতিবাহিত হলো। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামে সফল এই শিল্পোদ্যাক্তার জন্ম। শৈশব আর কৈশোর কেটেছে এখানেই। মাত্র দেড় বছর বয়সেই বাবাকে হারান। এরপর গ্রামের ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে মেট্রিক পাস করেন। এর পর চলে যান ঢাকায়। ভর্তি হন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে। ১৯৫৪ সালে এইচএসসি পাস করেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ডিপিআই অফিসে হিসাব শাখায় ৯০ টাকা বেতনের একটি চাকরিও করতেন। ১৯৫৫ সালের ৩রা আগস্ট মায়ের পছন্দের পাত্রীর (হুরুন নাহার) সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া অবস্থায় বেশ কয়েকটি ভালো চাকরির অফারও পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে বিকম পাস করেন এবং এরপর চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস কোর্স সমাপ্ত করেন।
১৯৫৮ সালে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যখন অস্থির ছিল তখন লন্ডনে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির অফার আসলেও তার মা না চাওয়ার কারণে সেদিন আর লন্ডনে যাওয়া হয়নি। তখন তিনি জেদ ধরলেন ব্যবসা করবেন। আদমজীতে অডিটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সেখানে অডিট করতেন। তার টার্গেট ছিল কীভাবে ব্যবসা শুরু করবেন। ব্যবসা করার জন্য যে টাকা প্রয়োজন তা তার ছিল না। আদমজীতে অডিট করার সময় সেখানকার এক কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদের সঙ্গে তার পরিচয় হলো। সেখানে তাকে (মুন্নু) চাকরির অফার দেয়া হলেও তার সাফ কথা ছিল- চাকরি নয় ব্যবসা করবেন। নূর মোহাম্মদকে তিনি বোঝাতে সক্ষম হন। অফিসের পারচেজ হেড ছলিমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সব কথা শোনার পর ছলিম তাকে (মুন্নু) বললেন- কোন্ ধরনের ব্যবসা করতে চান। তাৎক্ষণিকভাবে ঠিক করলেন প্রিন্টিং ব্যবসায় যাওয়া যায়। কারণ তিনি তখন একটি আর্ট প্রেসে খণ্ডকালীন অ্যাকাউন্টসের কাজ করতেন। তাই প্রেসের ব্যবসা সম্পর্কে তার একটা ধারণা ছিল। সেই ব্যবসায় মুনাফা পেলাম ৭৫ টাকা। তখন থেকেই শুরু হয় তার ব্যবসা। অর্ডার পান আর সাপ্লাই দেন। দুই বছরের মধ্যে প্রেস তৈরির টাকাও হয়ে গেল। সততা আর নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে যান সামনের দিকে। যে কাজেই হাত দেন সে কাজেই আসে সফলতা। ঢাকার ওয়ারিতে তার প্রতিষ্ঠিত প্রথম ব্যবসা শুরু হয় মুন্নু আর্ট প্রেস দিয়ে। সেই প্রেসই তার উপরে উঠার প্রথম সিঁড়ি। এরপর মুন্নু আর্ট প্রেস অ্যান্ড প্যাকেজিং, মুন্নু জুটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মুন্নু স্টাফলার্স লিমিটেড, মুন্নু সিরামিক্স, বন চায়না, মুন্নু ট্রেনিং কমপ্লেক্স সহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। স্বনামধন্য ব্যবসায়ী হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান এই মানুষটি। এরপর নিজ জেলা মানিকগঞ্জের গিলন্ড এলাকায় তার ব্যবসার প্রসার বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী হিসেবে দেশ-বিদেশে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তবে মুন্নু সিরামিক্স সারা দুনিয়ায় একটি ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
মুন্নু তার নিজ জেলা মানিকগঞ্জের গিলন্ড এলাকার মুন্নু সিটিতে ২০১১ সালে গড়ে তুলেছেন স্বপ্নের মুন্নু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ২০১৩ সালে মুন্নু সিটিতে স্থাপন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানের মুন্নু ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। মুন্নু সিটিতে আরো প্রতিষ্ঠা করেছেন মুন্নু মেডিকেল নার্সিং কলেজ। আরো রয়েছে মুন্নু ফেব্রিক্স ও মুন্নু অ্যাটেয়ার। যেখানে কয়েক হাজার বেকার নারী-পুরুষ কাজ করছেন। প্রস্তাবিত রয়েছে মুন্নু ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এম ইউ এস টি)। দৃষ্টিনন্দন এই মুন্নু সিটি মানিকগঞ্জ জেলাকে দেশ-বিদেশে পরিচিত করে তুলেছে এক মডেল হিসেবে। শুধু তাই নয়, হারুনার রশিদ খান মুন্নু মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় আরো কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। গড়ে তুলেছেন পদ্মায় ভাঙনকবলিত ছিন্নমূল মানুষের জন্য ‘রিতা আবাসন প্রকল্প’।
এ ছাড়া প্রয়াত হারুনার রশিদ খান মুন্নু বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছিলেন ক্লিন ইমেজের ব্যক্তি। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সালের প্রত্যেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, ২০০১ সালে মানিকগঞ্জে সাবেক ২ ও ৩ আসন থেকে একই সঙ্গে নির্বাচন করে দুটিতেই জয়লাভ করেন। মন্ত্রিত্বও পান।
আজ তিনি নেই। ২০১৭ সালে নিজের প্রতিষ্ঠিত মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মুন্নু সিটির ক্যাম্পাসের দৃষ্টিনন্দন হুরুন নাহার জামে মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। এদিকে মৃত্যুর তিন বছরেও প্রিয় বাবাকে একটি মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেনি পরিবারের বড় মেয়ে মুন্নু গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আফরোজা খান রিতাসহ পরিবারের সদস্যরা। বাবার আদর্শ, কর্ম উদ্দীপনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিজের ভেতর ধারণ ও লালন করে পথ চলছেন তিনি। ছোট বেলা থেকেই বাবার সততা আর আদর্শে মুগ্ধ ছিলেন রিতা। বাবার আদর্শের দীক্ষাতেই রিতা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাবার প্রতিষ্ঠিত মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মুন্নু ফেব্রিক্স, মুন্নু অ্যাটেয়ার, মুন্নু জুটেক্স, মুন্নু জুট স্টাফলার্স, মুন্নু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মুন্নু ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মুন্নু নার্সিং কলেজসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানকে। বাবার মতো তিনিও হয়ে উঠেছেন একজন সফল শিল্পোদ্যোক্তা।