(১) ১৯১৪ সাল । ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনের অধীন । ‘কালো আদমিদের ‘ উপর চলছে অত্যাচার শোষণ । প্রায় ৩৭৬ জন ভারতীও কে নিয়ে ‘ কামাতাগা মারু ( Kamataga Maru ) নামে একটি জাপানিজ জাহাজ কানাডার বন্দর শহর ভ্যাঙ্কুভারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে । এদের মধ্যে ছিলেন শিখ সম্প্রদায়ের ৩৩৭ জন । মুসলিম ছিলেন ২৭ জন । আর হিন্দু ১২ জন । গুরুদিত সিং ( Gurudit singh ) ছিলেন একজন নেতা এবং ব্যাবসায়ী । ভারতবর্ষকে ব্রিটিশদের কবল মুক্ত করার জন্য প্রবাসী সংগ্রামী । তিনি ছিলেন এই সাগর যাত্রার অন্যতম সহযোগী । ভেবেছিলেন ক্যানাডা কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশ হিসেবে ব্রিটিশ শাসনে জর্জরিত ভারতীয়দের আশ্রয় হবে ক্যানাডায় । তারা জানতেন দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসীদের জন্য সহজ হবে না ক্যানাডায় প্রবেশ করা । তারপরেও জীবনকে হাতে নিয়ে , সুন্দর জীবনের আশানিয়ে শুরু হয় সাগর যাত্রা ।
হংকং থেকে ১৯১৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল যাত্রা শুরু করে ‘কামাতাগা মারু’ । প্রায় দেরমাস পর মে মাসের ২৭ তারিখে ‘কামাতাগা মারু’ প্রবেশ করে ভ্যাঙ্কুভারের জলসীমানায় । কিন্তু জাহাজটিকে নোঙর করতে দেয়া হোল না বন্দরে । আগে থেকেই ক্যানাডায় দক্ষিন এসিয়ানরা যেন আসতে না পারে তার তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিলো । ইমিগ্রেশন আইন কঠোর থেকে কঠোর হচ্ছিলো । প্রত্যেক যাত্রীর কাছে থাকতে হবে ২০০ ডলার ।আসতে হবে সরাসরি ভারত থেকে। অনেক দেন দরবার করেও কোন সমাধান হোল না । ২৪ জনকে প্রবেশের অনুমুতি দেয়া হোল । বাকীদের প্রায় দুইমাস পর জুলাই মাসের ২৩ তারিখে ক্যানাডা বন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হোল । জাহাজ থেকে কেউ যেন ঝাঁপ দিয়ে বন্দরে পৌছাতে না পারে তাই কয়েকটা সামরিক নৌযান জাহাজটিকে অনেক দূর অনুসরন করে ।
সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখে জাহাজটি কলকাতা বন্দরে নোঙ্গর করে । দেশদ্রোহিতার অপরাধে ২২জনকে হত্যা করা হয় । ২০০র বেশী জনের স্থান হয় কারাগারের অন্ধকার ।
বহুল আলোচিত এই নিরমতার জন্য প্রায় ১০০ বছর পর ২০১৮ সালে ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পার্লামেন্টে ক্ষমা প্রার্থনা করেন । কামাতাগা মারুর সেইসব যাত্রিদের কাছে এই ক্ষমার বানী কোনদিন পৌঁছাবে না । ট্রুডো বলেন ,” Mr. Speaker, today I rise in this House to offer an apology on behalf of the Government of Canada, for our role in the Komagata Maru incident.
More than a century ago, a great injustice took place ”
”No words can fully erase the pain and suffering they experienced. Regrettably, the passage of time means that none are alive to hear our apology today.”
(২) ১৯৩৯ সাল । জাহাজের নাম এসএস সেন্ট লুইস ( SS St Louis ) । যাত্রী সংখ্যা ৯৩৭ । সবাই ইহুদী । সারা ইউরোপেই তখন চলছে ইহুদী বিদ্বেষ । হামবুর্গ থেকে মে মাসের ১৩ তারিখে জার্মানের তৃতীয় রাইখের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেন্ট লুইস যাত্রা শুরু করে কিউবার উদ্দেশ্যে । দুই সপ্তাহ পরে সেন্ট লুইস হাভানা বন্দরে নোঙর করে । সেখানেও চলছে অভিবাসী ও ইহুদী বিরোধী বিক্ষোভ । অনেকেই সেখানে ইহুদিদের ‘কমিউনিস্ট’ হিসেবে আখ্যা দেয় । অনেক দেন দরবার শেষে ২৯ জন কে হাভানায় প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয় । তারপর ৯০৭ জন যাত্রি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি বন্দরের দিকে যাত্রা করে সেন্ট লুইস । জাহাজ থেকে দেখা গেল মায়ামি বন্দরের আলোক শোভা । যোগাযোগ করা হল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সাথে । কোন সাড়া পাওয়া গেল না । স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে বলা হোল অভীবাসী কোটা পূর্ণ । অপেক্ষা করতে হবে ওয়েটিং লিস্ট অনুযায়ী । বেশ আগে থেকেই কংগ্রেস এবং এ্যমেরিকান জনগণ কোটার বাইরে ইহুদিদের অভিবাসনের বিরুদ্ধে ছিলো । ১৯৩৮ সালের জরিপে জানা যায় ৭১% এমেরিকান ইহুদী অভিবাসনের বিরুদ্ধে ছিল । এমনকি ইহুদী শিশুরাও যেন এমেরিকায় আসতে না পারে তার বিরুদ্ধেও কংগ্রেস এবং জনগনের অবস্থান ছিল । ” ইহুদীরা লোভী ” । জার্মান স্পাই । এমন অপবাদও দেয়া হয় । ফেরত পাঠান হোল সেন্ট লুইসকে । জাহাজ থেকে কেউ যেন ঝাঁপ দিয়ে বন্দরে পৌছাতে না পারে তাই কয়েকটা সামরিক নৌযান জাহাজটিকে অনেক দূর অনুসরন করে । জাহাজের একজন যাত্রী পরে যাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে হত্যা করা হয় তখন বলেছিলেন ,” ( Nobody want us)”
সেন্ট লুইসের যাত্রীরা ক্যানাডায় যাওয়ার কথা ভাবে । কিন্তু ক্যানাডা থেকেও অপারগতা জানিয়ে দেওয়া হয় । প্রায় একমাস পর বেচে থাকার আশা নিয়ে সাগরে ভেসেভেসে অবশেষে বেলজিয়ামের বন্দরে ভেড়ে সেন্ট লুইস । ব্রিটেন , বেলজিয়াম , নেদারল্যান্ড ,ফ্রান্স যাত্রীদের ভাগাভাগি করে আশ্রয় দেয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন সময়, এদের মদ্ধে ২৫৪ জনের মৃত্যু হয় জার্মানের বিভিন্ন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে । ২০১২ সালে ইউ এস স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে সেন্ট লুইসের যাত্রীদের যারা বেচে ছিলেন এবং সারা পৃথিবীর কাছে ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়ের জন্য ক্ষমা চাওয়া হয় ।
(৩) পৃথিবীতে এখনো যুদ্ধ থেমে নেই । অর্থনৈতিক ,রাজনৈতিক ,পরিবেশগত সংকট-সঙ্ঘাত , দুর্ভিক্ষ , মহামারী এশিয়া , আফ্রিকা , আরব ,ল্যাটিন এমেরিকার দেশে দেশে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। পশ্চিমা শক্তি ও তাদের স্থানীও মিত্ররা বহু বছর ধরেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশ সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য বিস্তার করে সাধারনের জীবন অস্থিতিশীল করে তুলেছে । বিভিন্ন জাতীয় , আঞ্চলিক ও ধরমীও সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর উপর নিরাপদ দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে । ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি !! বেচে থাকার আশা নিয়ে, সুস্থ , স্বাভাবিক ,নিরাপদ জীবনের আশায় লক্ষ মানুষ পাহাড় , গিরিপথ , গভীর অরন্য , তপ্ত মরিভূমী , সাগরের পর সাগরের দুর্গম ,বিপদ সঙ্কুল পথ অতক্রম করছে । ্কেউবা খুজে পেয়েছে কাংখিত অভিবাসন । কেউবা আছে জেলে । কেউ নিঃস্ব হয়ে ফিরেছে । কারো স্থান হয়েছে গণকবরে । কেউবা ভেসে গেছে জলে সাগরের গভীর অতলান্তে । মাঝেমাঝে সাগরের ঢেউ কাউকে ঠেলে নিয়ে আসে তীরে । তাদের নিরব নীথর দেহ অনেক অভিমানে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে সাগরবেলায় ।