জলবায়ু পরিবর্তন

নিয়ন্ত্রণহীন পর্যটনে বিপন্ন সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য

লেখক: নির্বাহী সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেইঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (সাকজেএফ)।এক সপ্তাহ আগে দেশের চিত্রশিল্পী ফরিদী নুমানের উদ্যোগে বাংলাদেশের ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফারদের একটি দলের সঙ্গে সুন্দরবনে গিয়েছিলাম। ফাইবার বডির ছোট জাহাজ গাঙচিল থেকে নেমে ছোট নৌকায় সুন্দরবনের সরু খালগুলোতে ডুকতেই আমার চক্ষু কপালে ওঠার দশা। ভাটির সময়ে খালগুলোতে ঝুলে থাকা গাছ ও গুল্মলতার সঙ্গে ঝুলে খন্ডখন্ড পলিথিন, পানির বোতল, চিপসের প্যাকেটসহ অসংখ্য অপচনশীল দ্রব্য। এসব অপচনশীল দ্রব্য সুন্দরবনের প্রাণ সুন্দরী গাছের শ্বাসমুখে আটকে থেকে এর অক্সিজেন প্রবাহকে বাধাগ্রস্থ করছে। এমন অসংখ্যা প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণ মূলত: সুন্দরবনের অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন।

অনিয়ন্ত্রিত ও অসচেতন পর্যটকরা সুন্দরবনকে ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু একটি বনে পরিণত করেছে। বড় বড় ক্রুজ শীপের উজ্জ্বল আলো সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকেও পাল্টে দিচ্ছে। এখানকার পশু ও পাখির জীবনচক্রে পরিবর্তনে বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে আগের মতো এখন আর পাখির সমাহারও নেই সুন্দরবনে।

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। একদিকে বঙ্গোপসাগরের নোনা জল, অন্যদিকে হিমালয় থেকে নেমে আসা পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মিষ্টি জল। এই দুই স্রোতের মিলনে জন্ম নিয়েছে যে বিস্ময়কর বন, তার নাম সুন্দরবন। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা বাংলাদেশ ও ভারত নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে ৬,৫১৭ বর্গকিলোমিটার এবং ভারত অংশে বাকি অংশ অবস্থিত। অথচ দুই হাজার বছর আগে এই বনভূমির পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। মানব-আগ্রাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, অযত্ন ও লোভের কারণে সেই বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সম্পদ ক্রমে সঙ্কুচিত হয়েছে।

লেখক: নির্বাহী সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেইঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (সাকজেএফ)।আজ সুন্দরবন নতুন এক বিপদের মুখে। প্রতিদিন শত শত বড় বড় ক্রুজ শিপে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমাচ্ছেন সুন্দরবনের অন্তরে। হরিণের পাল, জলে ভেসে ওঠা ডলফিন, কিংবা দূর থেকে এক ঝলক রয়েল বেঙ্গল টাইগার—এই আকর্ষণই টেনে আনছে ভ্রমণপিপাসু মানুষকে। কিন্তু এর ফল ভয়াবহ। প্রকৃতি হারাচ্ছে তার ভারসাম্য, বন্যপ্রাণী তাড়িত হচ্ছে, জলে জমছে বর্জ্য, আর শব্দদূষণে হারিয়ে যাচ্ছে বনভূমির নির্জনতা।

পৃথিবীর বুকে একমাত্র এই বনেই রয়েছে শ্বাসমূল বা নলাকার শিকড়বিশিষ্ট গাছপালা। মাটির উপর উঠে আসা এই শিকড়গুলো শুধু গাছকে অক্সিজেন জোগায় না, জলজ প্রাণীর আশ্রয়ও তৈরি করে। ছোট মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, ঝিনুক কিংবা পাখিরা এই বনের মধ্যে খাদ্য ও নিরাপত্তা খুঁজে পায়। একই সঙ্গে ম্যানগ্রোভ শ্বাস নেয় কার্বন, রুখে দেয় বিশ্ব উষ্ণায়নের ঝড়। সবচেয়ে বড় কথা, বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের প্রথম আঘাত গিয়ে লাগে এই বনভূমির গায়ে। বাংলাদেশের উপকূলীয় লাখো মানুষের কাছে সুন্দরবন কেবল বন ও বন্য প্রাণীর নয়, মানুষেরও রক্ষাকবচ।

সুন্দরবন শুধু বন নয়, এটি জীব বৈচিত্রের এক অফুরন্ত ভান্ডার। একটি পরিসংখ্যান দিলে বোঝা যাবে যে, বাংলাদেশে মোট প্রায় ১১,৮০০ প্রজাতির প্রাণী চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে একা সুন্দরবনেই রয়েছে প্রায় ২,২০০ প্রজাতি। দেশে শনাক্ত ৭,৯৭৩ প্রজাতির মধ্যে ১,৫১৫ প্রজাতিই এ বনে। সুন্দরবনের সবচেয়ে পরিচিত প্রাণী হরিণ। প্রায় এক লক্ষ হরিণ এখানে আছে বলে ধারণা। অথচ প্রতি বছর শিকারিদের হাতে মারা পড়ে ১০-১২ হাজার হরিণ।

এক সময় দেশের নানা প্রান্তে দেখা মিলত কুমির । এখন কেবল সুন্দরবনেই আছে ১৫০-২০০টি। সুন্দরবন সংলগ্ন বাসিন্দারা প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার টন কাঁকড়া সংগ্রহ করেন। দেশের মোট মাছের প্রায় ৩০ শতাংশ আসে এখান থেকে। চার প্রজাতির প্রায় ৬ হাজার ডলফিনের বাস এখানে। এর মধ্যে ইরাবতী ডলফিনের সংখ্যা সুন্দরবনেই সর্বাধিক।

লতা থেকে শুরু করে সুউচ্চ বৃক্ষ—মোট ৩৩৪ প্রজাতির গাছ রয়েছে সুন্দরবনে। নোনা জলের কারণে ফলজ বৃক্ষ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বে ৪৮ প্রজাতির গেওয়া গাছ আছে, তার মধ্যে ১৯ প্রজাতিই সুন্দরবনে। সবচেয়ে মূল্যবান সুন্দরী গাছ বনভূমির প্রায় ১১ শতাংশ জুড়ে আছে। বিপন্ন প্রজাতির রাজগোখরা বা কিং কোবরা এখনও টিকে আছে এই অরণ্যে। ভোঁদর নামের স্তন্যপায়ী প্রাণীও এখন কেবল সুন্দরবনেই দেখা যায়।
১৯৩০ সালে দেশের ১১ জেলায় বাঘের উপস্থিতি ছিল। এখন তারা কেবল সুন্দরবনে। ২০০৪ সালের সমীক্ষায় ৪৪০টি বাঘের হিসেব মিলেছিল। এখন সংখ্যা আরও কমে এক তৃতীয়াংশে নেমেছে।

২০২৪ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি। এই সংখ্যাটি আগের জরিপের তুলনায় বেশি, যেখানে ২০১৮ সালে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ গণনা করা হয়েছিল। গত পাঁচ বছরে করা দুটি আলাদা জরিপের মধ্যে দেখা গেছে; দেশে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার, প্রকল্পভিত্তিক কার্যক্রম এবং বাঘ হত্যায় জিরো টলারেন্স নীতির কারণে এ সাফল্য এসেছে। একসময় সুন্দরবনে বাঘ কমে গিয়েছিল গুপ্ত শিকারি, বনদস্যুদের উৎপাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অভয়ারণ্যে অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের কারণে।

আজকের সবচেয়ে বড় সংকট পর্যটন। পর্যটক আসবেন, প্রকৃতি দেখবেন—এতে আপত্তি নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, কীভাবে আসবেন? প্রতিদিন বিশাল ক্রুজ শিপের বহর ভেসে ঢুকছে বনের ভেতরে। ইঞ্জিনের শব্দে ভয় পাচ্ছে ডলফিন, পাখি ফেলে যাচ্ছে বাসা, হরিণ ছুটে যাচ্ছে গভীর বনে। জ্বালানি তেল গিয়ে মিশছে জলে, প্লাস্টিক ও বর্জ্যে ভরে যাচ্ছে নদী-খাল। প্রকৃতির শান্ত নির্জনতাকে পর্যটনের ভিড় প্রতিনিয়ত চূর্ণ করছে। এই অযত্নশীল ভ্রমণ কেবল প্রাণীদের নয়, ক্ষতিগ্রস্ত করছে স্থানীয় মানুষের জীবনও। বন থেকে মধু, মাছ বা কাঁকড়া সংগ্রহ করে বাঁচেন তারা। জীববৈচিত্র্য কমে গেলে তাদের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে যাবে।

পর্যটনের বাইরেও আছে আরও বড় ভয়—জলবায়ু পরিবর্তন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, নোনা জল ঢুকে পড়ছে বনের গভীরে। ফলে ফলজ গাছ হারিয়ে যাচ্ছে, প্রাণীরা খাদ্য পাচ্ছে না। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা—সবচেয়ে আগে আঘাত পাচ্ছে সুন্দরবন। অথচ এটাই, পৃথিবীকে বাঁচাতে কার্বন শোষণ করছে এই বন, অথচ গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে সবার আগে হুমকির মুখে পড়ছে সে-ই।

সুন্দরবন রক্ষায় এখনই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। প্রথমত, পর্যটনে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। প্রতিদিন কত নৌযান যাবে, কোথায় যাবে, কী ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করবে—সব কিছুর ওপর নিয়ম করতে হবে। বড় বড় ক্রুজ শিপ নয়, পরিবেশবান্ধব ছোট নৌকা ব্যবহার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিকার বন্ধ করতে হবে কঠোর হাতে। স্থানীয় মানুষকে বিকল্প জীবিকা দিতে হবে, যাতে তারা বনের সম্পদ ধ্বংস না করে টিকে থাকতে পারে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগ জরুরি। কারণ সুন্দরবন দুই দেশের বুক জুড়ে বিস্তৃত। জলবায়ু পরিবর্তন, চোরা শিকার, বন উজাড়—সব সমস্যাই সীমান্তের ওপারে ছড়িয়ে আছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও প্রয়োজন, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত দুই দিকেই।

সুন্দরবন শুধু একটি বন নয়। এটি এক ঢাল, এক আশ্রয়, এক খাদ্যভাণ্ডার। লাখো মানুষের জীবিকার সঙ্গী, হাজারো প্রাণীর শেষ আশ্রয়স্থল। এই বনের মৃত্যু মানে কেবল একটি দেশ বা একটি জাতির ক্ষতি নয়, সমগ্র পৃথিবীর ক্ষতি। পর্যটনের অযত্ন আর জলবায়ুর আঘাতে যদি একদিন সুন্দরবন হারিয়ে যায়, তখন আমরা বুঝব, কী ভয়াবহ উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছি আগামী প্রজন্মের হাতে। সুন্দরবনকে বাঁচানো আজ দায়িত্ব নয়, প্রয়োজন। নিজেদের জন্য, পৃথিবীর জন্য, ভবিষ্যতের জন্য।

লেখক: নির্বাহী সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেইঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (সাকজেএফ)।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker