করোনাভাইরাস রঙ্গমঞ্চ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা
বেশ ভালভাবেই চালানো হলো মহড়া। প্রকাশ্য দিবালোকে, সবার চোখের সামনে। হাততালিও জুটেছেবেশ। অনেকে একে আশ্রয় করেই আগামী দিনের বিশ^ব্যবস্থা কল্পনা করছেন। আবার অনেকে উচ্চারণকরেছেন সতর্কতা। প্রসঙ্গ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সংক্ষেপে- এআই।
করোনাভাইরাস মহামারীকালে কৃত্রিম বুদ্ধির ঝিলিক দেখলো বিশ^বাসী। হাসপাতালে রোবট দিয়ে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগির চিকিৎসা, রোগের কারণ অনুসন্ধান, গবেষণা, হোটেলে খাবারপরিবেশন, নিঃসঙ্গ প্রবীণদের সঙ্গদান। কিংবা ড্রোন দিয়ে খাদ্য পৌঁছে দেয়া, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বা রাস্তায়জীবাণুনাশক ছিটানো। ড্রোন আর রোবট দিয়ে করোনাভাইরাস মোকাবেলার এসব চেষ্টা সবার দৃষ্টিকেড়েছে।
করোনা মহামারীর মতো পরিস্থিতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে কতটা সহায়ক হতে পারে, তার আরেকটিনজির সৃষ্টি করেছে জার্মানির দু’টি কোম্পানি। তারা সম্মিলিতভাবে রোবট ব্যবহার করে এক সপ্তাহেরমধ্যে একটি পুরোপুরি অটোমেটিক উৎপাদন প্রক্রিয়া গড়তে স¶ম হয়েছেন। আর এ প্রক্রিয়া ব্যবহার করেজার্মানিতে দ্রুত ফেস মাস্ক তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে।
রোবটের একটি প্রাকৃতিক সুবিধা হলো, করোনা ভাইরাস মেশিনকে আক্রান্ত করতে পারে না। তাইইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রোবটিকস-আইএফআর’র সুসানে বিলার মনে করেন, করোনাসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা তোলার পর বেশি করে রোবট ব্যবহার করে দোকানপাটে মানুষ কর্মীর ব্যবহার কমিয়েফেলা সম্ভব। এতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সহজ হবে। তিনি এমনকি প্রতি দ্বিতীয় কর্মক্ষেত্রে আপাতত একটি রোবট বসানোর সম্ভাবনা দেখছেন।
আর এ সম্ভাবনাই অনেকের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনাভাইরাস নিয়েষড়যন্ত্রতত্ত¡কারীরা নানা মত সামনে নিয়ে এসেছেন। তাদের একাংশ বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকেসক্রিয়ভাবে কাজে লাগাতেই বিশ^জুড়ে সুপরিকল্পিতভাবে করোনাভাইরাস ছড়ানো হয়েছে, মানুষকেগৃহবন্দি করে রোবটকে সামনে আনা হয়েছে। যন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে পিছনে উৎপাদন ব্যয় কমানোরষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
আগামী দশকগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কীভাবে রোবটকে সম্পৃক্ত করা হবে তা নিয়ে লেখালেখিকরেন মার্টিন ফোর্ড। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, মানুষ সাধারণত যোগাযোগের জন্য আরেকজনমানুষকেই চান। কিন্তু করোনাভাইরাস তা বদলে দিয়েছে। এটা ভোক্তার অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো পাল্টেদিতে চলেছে এবং অটোমেশনের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে।
করোনাভাইরাস সঙ্কটকালে অনেক বড় ও ছোট কোম্পানি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং কর্মক্ষেত্রে সশরীরে কর্মীদের উপস্থিতি কমানোর জন্য রোবট ব্যবহার করছে। কর্মীরা বাসা থেকে যেসবকাজ করতে পারে না সেগুলোর জন্যও রোবটের ব্যবহার হচ্ছে।
২০২১ সাল পর্যন্ত কিছু মাত্রায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার দরকার হতে পারে বলে সতর্ক করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সেক্ষেত্রে রোবট কর্মীর চাহিদা বেড়ে যাবে। ম্যাকডোনাল্ডসের মতো ফাস্ট-ফুড চেইনগুলো খাবার তৈরি ও পরিবেশনে পরীক্ষামূলকভাবে রোবট ব্যবহার করছে। অ্যামাজন ও ওয়ালমার্টের গুদামে কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য এরইমধ্যে রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দু’টি কোম্পানিই পণ্য বাছাই, শিপিং ও প্যাকেটজাত করার জন্য রোবটেরব্যবহার বাড়ানোর চিন্তা করছে।
এর মধ্য দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে গুদামে কর্মীদের একজন থেকে আরেকজনের দূরত্ব বজায় রেখেচলতে না পারার অভিযোগ কমে আসবে। তবে ওই কর্মীদের অনেকে চাকরি হারাবেন বলে মনে করছেনপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।
একবার কোনো কোম্পানি মানুষের জায়গায় রোবট বসালে তাদের আবার ওই কর্মীকে নেওয়ার সম্ভাবনাখুব কম। রোবট এনে কাজ শুরু করানোটা খুব ব্যয়বহুল, তবে একবার বসাতে পারলে তা মানুষ কর্মীরচেয়ে সাশ্রয়ী। গ্লোবাল কনসালট্যান্ট ম্যাককিনজি ২০১৭ সালে লেখা এক প্রতিবেদনে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে, ২০৩০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে অটোমেশন বা রোবট ব্যবহারের কারণে এক তৃতীয়াংশ মানুষ কাজ হারাবে।
বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়াচ্ছে। ফেইসবুক ও গুগল অযৌক্তিক পোস্ট সরিয়েদেওয়ার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করছে। তাদের কনটেন্ট মডারেটররা ঘরে থেকে অনেক কিছু পর্যালোচনা করতে না পারায় এই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।
নিজেদের এমএসএন ওয়েবসাইটের সংবাদ বাছাইয়ের জন্য এখন থেকে সাংবাদিকের বদলে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া ব্যবহার করবে বলে জানিয়েছে মাইক্রোসফট। ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে চাকরিহারাচ্ছেন ৫০ জন সাংবাদিক। আর দশটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মতো মাইক্রোসফটও নিজ ওয়েবসাইটেসংবাদ সেবা দিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে খবর কিনে থাকে। কিন্তু খবরগুলো কীভাবে উপস্থাপনকরা হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার নিয়োগপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের হাতে দিয়ে রেখেছিল প্রতিষ্ঠানটি।মাইক্রোসফটের পদক্ষেপের ফলে এখন থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা করবে এ কাজগুলো। অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো মাইক্রোসফটও খরচ কমাতে ‘রোবট সাংবাদিকতা’ নিয়ে পরীক্ষা চালাতে চাইছে। এটি কীভাবে কাজ করে তা বুঝতে গুগলও এরকম বেশ কিছু প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে।
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।তারা হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলছেন, এই প্রযুক্তি যদি আন্তর্জাতিক আইন কানুনের তোয়াক্কা করে না এমনরাষ্ট্র কিম্বা সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যায় তাহলে এর বড় ধরনের অপব্যবহার হতে পারে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিউচার অফ হিউম্যানিটি ইন্সটিটিউটের মাইলস ব্রান্ডেজ বলেন, মানুষের, প্রতিষ্ঠানের ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকির চিত্র বদলে দেবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। দুর্বৃত্তরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে হ্যাক করার উদ্দেশ্যে, মানুষের গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা হতে পারে- নিরাপত্তার ব্যাপারে সব ধরনের ঝুঁকিই এখানে আছে। বেশিরভাগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই প্রযুক্তি যে শুধু মানুষের বুদ্ধির পর্যায়ে চলে যায় তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে এটা মানুষের বুদ্ধির সীমাকেও ছাড়িয়ে যায়। গবেষকরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবকিছু বদলে দিচ্ছে। আমরা এমন একবিশ্বে বাস করছি যা কিনা কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার অপব্যবহারের কারণে দিনে দিনে আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়েউঠতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভবিষ্যতে কিভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তার কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছেনবিশেষজ্ঞরা। যেমন: গুগল ডিপমাইন্ডের উদ্ভাবন করা আলফাগোর মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি।এটি এতো চালাক যে মানুষের বুদ্ধিকেও সে পরাজিত করতে পারে। এই প্রযুক্তি হ্যাকারদের হাতে পড়লেতথ্য চুরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোনো ব্যক্তি ড্রোন কিনে সেটিকে মানুষের মুখ চেনার জন্যে প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারে এবং তারপর পারে কোনো ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তার উপর আক্রমণ চালাতে। ভুয়া ভিডিও তৈরি করে তার রাজনৈতিক অপব্যবহার হতে পারে। স্পিচ সিনথেসিসের মাধ্যমেহ্যাকাররা অন্যের গলাও নকল করতে পারে। একশ’ পাতার এক রিপোর্টে গবেষকরা ডিজিটাল, শারীরিক ও রাজনৈতিক এ তিনটি এলাকায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপপ্রয়োগ হতে পারে বলে চিহ্নিত করেছেন।
আর একারণে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যখন তৈরি করা হচ্ছে তখন এর উদ্ভাবকদের একই সাথে এমনজিনিসও তৈরি করতে হবে যাতে এর অপব্যবহার না হয়, আর হলেও সেটা যেন মোকাবেলা করা যায়- বলছেন গবেষকরা। এই লক্ষ্যে গবেষকের একটি দল নতুন কিছু আইন কানুন তৈরি করার উপরেও জোর দিচ্ছেন। তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন ক্যাথলিক চার্চের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। ফেব্রæয়ারি মাসেটেকনোলজি কোম্পানীগুলোর সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ‘রোম কল ফর এআই এথিকস’ নামেরঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। এতে আশা করা হয় যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টপ্রাশাসনিক কাঠামো গড়ে না উঠা পর্যন্ত একে ইতিবাচক কাজে ব্যবহার করতে হবে। এ ঘোষণায় মানুষের মর্যাদা বা মানবাধিকারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কর্মসূচি বিবেচনায় নিতে এর নির্মাতাদের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ আহবানের বেশিরভাগ নীতিগত ভাষা মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র থেকে নেয়া হয়েছে। শিল্পকারখানায় রোবটের ব্যবহার বাড়লে মানুষের চাহিদা কমবে বলে একটি ধারণা দীর্ঘদিন ধরেইরয়েছে। আর এতে অনেক মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। করোনা সংকটে গৃহবন্দি থাকায় বিষয়টি অনেকের কাছেই অজানা। তবে করোনা পরবর্তী বিশ্বে রোবটের ব্যবহার বাড়ানোর বিরোধিতা আবারো গতি পেতে পারে- এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
#লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইমেইল: atmustakim@gmail.com