সোমপুর মহাবিহার: যেখানে ভিনদেশী বৌদ্ধদের জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটাতেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
পাহাড়পুরের সোমপুর বৌদ্ধ মহাবিহার বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। এর দেয়ালগুলোতে পোড়ামাটির চিত্রফলকে তৎকালীন সমাজের নানা দিক জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই বিহারের জ্যামিতিক নকশা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্থাপত্য কীর্তি।
অতীশ দীপঙ্কর এবং পাহাড়পুরে বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ — এই নামগুলো কি আপনার মনে কোনো কৌতূহল জাগায়? ইতিহাসে ডুব দিতে আর পুরনো দিনের রহস্য ভেদ করতে আপনি ভালোবাসেন? আজ আপনাদেরকে নিয়ে এক রোমাঞ্চকর অভিযানে বের হতে চলেছি। যেখানে খুঁজে নেব আমাদের সোনালী অতীত, ডুব দেব বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গভীরে। আমি এম আর জান্নাত স্বপন একজন সাংবাদিক এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এবং আমার এই ভ্লগে আপনাদের স্বাগতম। চলুন, একসঙ্গে শুরু করি এই জ্ঞান ও ঐতিহ্যের অন্বেষণ।
আপনাদের জানাবো বাংলাদেশের প্রাচীন এক বৌদ্ধ জ্ঞানপীঠ– পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহার সম্পর্কে। এরপর জানার চেষ্টা করব এই বিহারের সাথে জড়িয়ে থাকা এক কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জীবন ও কর্ম। শুধু তাই নয়, অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান বজ্রযোগিণী গ্রামেও যাব। জানাবো বর্তমানে তাঁর পবিত্র দেহভস্ম বাংলাদেশের কোথায় সংরক্ষিত আছে।
আমার অনুসন্ধিৎসু মন শুধু বাংলাদেশেই থেমে থাকবে না। ভ্রমণ করব ভারতের বিখ্যাত নালন্দা মহাবিহার পর্যন্ত। যা একসময় জ্ঞানচর্চার আলোকবর্তিকা ছিল। দৃষ্টি প্রসারিত হবে সুদূর চীনের তিব্বত পর্যন্ত। যেখানে অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ভ্রমন করবো গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনীতে। যা বর্তমানে নেপালে অবস্থিত এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য এক পবিত্র তীর্থস্থান। জানব সেইসব অজানা গল্প যা কালের গর্ভে চাপা পড়ে আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
জ্ঞানের মশাল: অতীশ দীপঙ্কর ও সোমপুরের মাটি
এই সেই স্থান। যেখানে এককালে জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়েছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মতো মহাপুরুষেরা। ভাবুন তো, সেই সময়ে কেমন ছিল এই জায়গাটা? কত ছাত্র আসত জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে! এক হারানো সভ্যতার নীরব সাক্ষী এই পাহাড়পুর।
ইতিহাসের স্পন্দন: পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার
এই বৌদ্ধ বিহারে এসে শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়ে অনুভব করছিলাম এক প্রাচীন ইতিহাসের স্পন্দন। লাল ইটের স্তূপ আর পোড়ামাটির ফলক যেখানে শতাব্দীর নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের সৌন্দর্য আমাকে যেমন মুগ্ধ করেছে তেমনই কৌতূহলী করে তুলেছে এর অতীত দিনের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য সম্পর্কে। পাঠ্যপুস্তকের পাতায় পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কথা পড়েছি; কিন্তু এখানে এসে যেন সেই ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠলো।
সোমপুর মহাবিহার: এক প্রাচীন শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র
সোমপুর মহাবিহার। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার নামেও যা পরিচিত। এটি একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। অষ্টম শতকে পাল রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল দেব এই বিশাল স্থাপনাটি নির্মাণ করেন। এটি শুধু বৌদ্ধ বিহারই নয়, একইসাথে ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বাসস্থান, শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র। এখানকার বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ছিলেন সেইসব জ্ঞান তাপস, যাঁরা গৃহত্যাগ করে ধর্মচর্চা ও সমাজের কল্যাণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেন।
দক্ষিণ হিমালয়ের জ্ঞানজ্যোতি: সোমপুর মহাবিহার
একারণেই বিহারটি এককালে দক্ষিণ হিমালয়ের বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। আয়তনের দিক থেকে এর সাথে ভারতের বিখ্যাত নালন্দা মহাবিহারের তুলনা করা চলে। এটি যুগ যুগ ধরে বৌদ্ধদের এক অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল।
বিশ্বজুড়ে জ্ঞানপিপাসুদের আগমন
শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, বরং চীন, তিব্বত, নেপাল, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া সহ পৃথিবীর নানা প্রান্তের বৌদ্ধ জ্ঞানার্থীরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে ছুটে আসতেন। এ কারণেই ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে জাতিসংঘের ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
আচার্য অতীশ দীপঙ্কর: জ্ঞানের আলোকবর্তিকা
খ্রিস্টীয় দশম শতকে এই বিহারের একজন বিখ্যাত আচার্য ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। “আচার্য” শব্দটি কেবল শিক্ষক পদবি নয়; এটি তাঁর অসাধারণ জ্ঞান, গভীর আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব, বৌদ্ধ ধর্মে সংস্কারমূলক ভূমিকা এবং সর্বজনীন সম্মানের সম্মিলিত রূপকে নির্দেশ করে। এসব ছিল তাঁর মহত্ত্ব ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একটি বিশেষ সম্মান।
পাহাড়পুরে অতীশ দীপঙ্করের পদচিহ্ন
এখানে এসে এই প্রাচীন বিহারের সাথে প্রখ্যাত বাঙালি পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের গভীর সম্পর্কের কথা জানতে পারলাম। নামটি আগে শুনেছি; কিন্তু পাহাড়পুরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তাঁর তাৎপর্য যেন আরও বেশি উপলব্ধি করলাম। মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগলো, কে ছিলেন এই অতীশ দীপঙ্কর? কেনই বা পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারের ইতিহাসে তাঁর নামটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মানবতার দীপশিখা: অতীশ দীপঙ্কর
অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন একাধারে পণ্ডিত, দার্শনিক ও ধর্মপ্রচারক। পাহাড়পুরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের এক গভীর বার্তা দেয়—জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মানবতাবাদের আদর্শ দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়েও অমলিন থাকে। তাঁর জীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করে জ্ঞানের অন্বেষণে, সত্যের সন্ধানে এবং মানব কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করতে। ধারণা করা হয়, এই বিহারে অবস্থানকালেই তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র রচনা ও সম্পাদনা করেছিলেন।
স্থাপত্যের বিস্ময়: সোমপুর মহাবিহারের গঠন
প্রায় ২৭ একর জমির উপর বিস্তৃত এই বিশাল বিহারের চারদিকে ১৭৭টি কক্ষ বিদ্যমান। যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাঁদের জ্ঞানচর্চা ও ধ্যান করতেন। বিহারের কেন্দ্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল স্তূপ। যা এর স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এর দেয়ালগুলোতে পোড়ামাটির চিত্রফলকে তৎকালীন সমাজের নানা দিক জীবন্ত হয়ে উঠেছে। যা এখানে আসা পর্যটকদের আজও মুগ্ধ করে। বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী সত্যিই অসাধারণ। এর দেয়ালে খোদাই করা টেরাকোটার চিত্রফলকগুলোতে তৎকালীন জীবনযাত্রার জীবন্ত ছবি পাওয়া যায়। এই বিহারের জ্যামিতিক নকশা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্থাপত্য কীর্তি। এই বিহারের ধ্বংসাবশেষ আজও আমাদের অতীতের গৌরবময় দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
কালের সাক্ষী: বিস্ময় জাগানো ধ্বংসাবশেষ
আজ আর সেই জৌলুস নেই। কালের বিবর্তনে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। তবুও এর ধ্বংসাবশেষ আজও আমাদের বিস্মিত করে। যারা ইতিহাস ভালোবাসেন, পুরনো দিনের কথা জানতে চান, তাদের জন্য এটা এক অমূল্য সম্পদ। এখানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে অনেক মূল্যবান জিনিস। যা সেই সময়ের সমাজ আর সংস্কৃতির পরিচয় দেয়। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার সত্যিই আমাদের এক অমূল্য সম্পদ। যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।
ঐতিহ্যের ঠিকানা: নওগাঁর পাহাড়পুর
বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুরে এই প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এটা শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান।
যেভাবে যাবেন: পাহাড়পুর অভিমুখে
ঢাকা থেকে পাহাড়পুরের দূরত্ব প্রায় ২৪৭ কিলোমিটার। বাসে করে যেতে ৫-৬ ঘণ্টা লাগতে পারে। আর যদি নওগাঁ শহর থেকে যেতে চান, তাহলে দূরত্ব মাত্র ৩২ কিলোমিটার। বালুডাংগা বাস টার্মিনাল থেকে লোকাল বাস বা অটোতে সহজেই পৌঁছে যাবেন। জয়পুরহাট থেকেও কাছেই, মাত্র ১৩ কিলোমিটার। বাস বা অটো ভাড়া করে অল্প সময়েই পৌঁছানো যায়। আর ট্রেনে যেতে চাইলে, প্রথমে জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে পাহাড়পুরের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। স্টেশন থেকে ভ্যান বা অটোতে করে যাওয়া যায়।